গত দুই দশকেরও কম সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে যে সংখ্যক ব্যবহারকারী সক্রিয় হয়েছেন, ডিজিটাল দুনিয়ায় তা এক বিস্ময়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সব শ্রেণির মানুষকে কথা বলার বা মত প্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছে— এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একই সঙ্গে তাদের নিজস্ব বিধি-বিধান আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক অ্যালগরিদম কোথাও না কোথাও মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করছে। তবে সমস্যাটিকে কেবল প্রযুক্তিগতভাবে দেখলে সার্বিক সমাধান আশা করা যায় না; কারণ প্রযুক্তির উৎকর্ষ একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের সাথে এর সক্ষমতা বাড়ে, ব্যবহারের পরিধিও বড় হয়। তাছাড়া গোড়ায় গলদ রেখে কেবল প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ দিয়ে ফেইসবুককেন্দ্রীক সমস্যাগুলো সমাধান সম্ভব নয়। এই আলোচনাটি কেবল ফেইসবুকের নীতিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে, কারণ বাংলাদেশে ফেইসবুক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে যেমন জনপ্রিয়, তেমনি তার প্রভাবও রাষ্ট্রের নানা স্তরে প্রকট। এই প্রভাব যেমন ইতিবাচক, তেমনি নেতিবাচকও। তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, এখন পর্যন্ত ব্যবহারকারীদের আইন বহির্ভূতভাবে তথ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে ফেইসবুকের বিরুদ্ধে যতগুলো অভিযোগ সামনে এসেছে, তার সিংহভাগই তাদের নীতিহীন কর্মপদ্ধতির কারণে, যেগুলোতে তারা নিজেদেরই বানানো গোপনীয়তা নীতি লঙ্ঘন করেছে। ক্যামব্রিজ অ্যানালেটিকা কেলেঙ্কারি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, যার মাধ্যমে ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচন এবং ব্রেক্সিট গণভোটে আইন বহির্ভূত প্রভাব বিস্তার করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে ফেইসবুক ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়টি নিয়ে সচেতন নয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ব্যবহারকারীদের চিত্রও আমাদের চেয়ে খুব একটা ভালো নয়— হলে কোটি কোটি ব্যবহারকারীর তথ্য ফেইসবুক নানা জায়গায় বিক্রি করতে পারত না। তার সঙ্গে যুক্ত আছে ফেইসবুকের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড। এই কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড দিয়েই ফেইসবুক দুই বিলিয়নেরও অধিক ব্যবহারকারীর বক্তব্য নিয়ন্ত্রণ করে। গত ১৩ সেপ্টেম্বর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত পাতায় ব্লগার, সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক জনাব অমি রহমান পিয়াল বাংলাদেশে গোপনীয়তা লঙ্ঘন করছে ফেইসবুক শীর্ষক যে নিবন্ধটি লিখেছেন, তা থেকে ফেইসবুকের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের দ্বিচারিতা স্পষ্ট। জনাব অমি রহমান পিয়াল বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে অনেকগুলো বিষয়কে সামনে তুলে এনেছেন। তিনি নিজে ফেইসবুকের এই দ্বিমুখী কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের শিকার। বারবার তার ব্যবহারের অধিকার সীমাবদ্ধ করা হচ্ছে কিন্তু তার বা তার সহযোদ্ধাদের অনেকের পোস্টে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিলেও সে বিষয়ে ফেইসবুক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও এদেশীয় যুদ্ধাপরাধীদের চালানো জেনোসাইডের ছবি ফেইসবুক সরিয়ে দিচ্ছে, মুছে দিচ্ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ আলোকচিত্র; কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো বা নারীর বিরুদ্ধে অবমাননাকর বক্তব্য-বিবৃতি-ছবি সবই দেদারসে নিউজ ফিডে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বারবার অভিযোগ জানালেও ফেইসবুক বলছে— এগুলো তাদের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড ভঙ্গ করেনি।
এই কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে বোঝা যায়, এখানে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য যেমন আছে, তেমনি একে ঘিরে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলয় তৈরির প্রচেষ্টাও আছে। মত প্রকাশের প্রতি দায়বদ্ধতার যে ঘোষণা এই কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের পাতায় পাতায় ঘোষিত হয়েছে, তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে— “… building community and bringing the world closer together.” (Community Standards, supra, note 7)। এখন এই কমিউনিটি গঠনের ভিত্তি কী? কোন কোন শর্তে ফেইসবুকের এই বিপুল সংখ্যক ব্যবহারকারী নিজেদের বিভিন্ন কমিউনিটির অন্তর্ভুক্ত মনে করবেন? এই প্রশ্ন থেকেই বোধ করি ফেইসবুকের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের স্বেচ্ছাচারিতা শুরু। যদি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করি, তবে দেখা যায় স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত পোস্টগুলোর অধিকাংশই বিজ্ঞাপনের আওতায় থাকে। এই বিজ্ঞাপন ব্যবহারকারীর পছন্দ-অপছন্দকে সবসময় গুরুত্ব দেয় না। তার মানে আচরণগত যে অ্যালগরিদমের কথা আমরা বলি, অর্থাৎ আমার পছন্দ অনুযায়ী পণ্য, বক্তব্য বা ছবি ফেইসবুক আমাকে দেখাবে, তা সর্বাংশে সত্য নয়। যদি তা-ই হতো, তবে মুসলিম নন এমন একজন ব্যবহারকারীকেও কেন ডিজিটাল কোরান বিক্রির বিজ্ঞাপন দেখানো হয়? কারণ এটি বিজ্ঞাপনদাতার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে বা বলা ভালো, যারা ফেইসবুকে নিয়মিত বিজ্ঞাপন দেন, তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার একটি প্রভাব আছে। এ কারণেই একজন ব্যবহারকারী না চাইলেও সাম্প্রদায়িক আজহারীর ফেইসবুক পেইজের বিজ্ঞাপন তাকে দেখতে হয়।
এমনই বেশকিছু বিষয় নিয়ে সম্প্রতি আলাপ তুলেছেন ফেইসবুকেরই সাবেক কর্মী ফ্রান্সেস হাউগেন। গতকাল মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকারে ফেইসবুকের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড প্রসঙ্গে হাউগেন বলেন, “আমরা এমন একটি তথ্যনির্ভর পারিপার্শিক অবস্থার মধ্যে আছি যেটা ক্ষোভ, বিদ্বেষ এবং মেরুকরণের কন্টেন্ট দিয়ে পূর্ণ, এটা আপনার নাগরিক বিশ্বাসকে ক্ষয় করতে থাকে, একে অন্যের উপর বিশ্বাস নষ্ট করতে থাকে, আমাদের একে অন্যের যত্ন নেওয়ার ক্ষমতা কমাতে থাকে। ফেইসবুকের যে সংস্করণটি এখন আছে সেটা আমাদের সমাজব্যবস্থাকে ছিড়ে ফেলছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতিগত সহিংসতার জন্ম দিচ্ছে।”
জনাব অমি রহমান পিয়াল তার লেখায় ফেইসবুক সৃষ্ট স্বেচ্ছাচারিতার যে দৃষ্টান্তগুলো তুলে ধরেছেন, তার প্রেক্ষিতে আমি খোঁজার চেষ্টা করেছি, ফেইসবুক এ প্রসঙ্গে কী বিধান রেখেছে। কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের সেকশন II.B অংশে প্রতিষ্ঠানটি ঘোষণা দিচ্ছে, নিজেদের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের বিরুদ্ধে গেলেও (…would otherwise go against our community standards…) সংবাদমূল্য ও জনস্বার্থ বিবেচনায় (… it is newsworthy and in the public interest…) কোনো কোনো পোস্ট তারা নাও সরাতে পারে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি প্রদানকারী মন্তব্যের মাঝেও ফেইসবুক সম্ভবত ‘জনস্বার্থ’ খুঁজে পায়! কারণ তাদেরই বানানো বিধান অনুযায়ী এই মন্তব্যগুলো তো থাকার কথা নয়। শুধু তাই নয়, হিংসা প্রচারের কারণে ব্যবহারকারীর প্রতিও শর্তারোপ হবার কথা। তেমন কথাই লেখা আছে কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের Violence and Incitement অনুচ্ছেদে।
এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ প্রযুক্তির ঘাড়ে দোষ চাপানো যায় না, কারণ আমরা জানি বাংলা ভাষার বিষয়ে তদারকির জন্য ফেইসবুক ইতোমধ্যে একাধিক ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে তারা কেন নেতিবাচকভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন? জনাব পিয়াল তার লেখায় বলেছেন, “আমি অভিযোগ করছি না বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘কমপ্রোমাইজড'”। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, তারা কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না। অর্থ বা রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রেক্ষিতে না হলেও ফেইসবুকের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের মধ্যে যে একাধিক গলদ আছে, সে গলদের কারণেও তারা কমপ্রোমাইজড হতে পারেন।
ফেইসবুকের সঙ্গে নীতি নির্ধারণী আলাপ-আলোচনায় বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার বিষয়ে গত কয়েক বছর ধরেই আমরা কথা বলছি। জানি না এর গুরুত্ব আদৌ সরকারের বিভিন্ন মহল উপলব্ধি করতে পারছেন কি না। এই আলোচনাটি জরুরি এ কারণেই যে, ফেইসবুক বিভিন্ন সময় তাদের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডে নানা ধরনের সংযোজন-বিয়োজন ও সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে। এই পরিবর্তনগুলো লক্ষ্য করলে বোঝা যায়, যে সব দেশ ইতোমধ্যে ফেইসবুকের ওপর প্রভাব তৈরি করতে পেরেছে, তাদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়গুলো তারা কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডে নথিভুক্ত করছে। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৮ ভাগ ফেইসবুক ব্যবহারকারী। জনসংখ্যার অনুপাতে এদেশে ফেইসবুকের ব্যবসাও রমরমা। সুতরাং বাংলাদেশ সরকার যদি আমাদের স্বার্থ, ইতিহাস, রাষ্ট্রের দর্শন, আইন ও সংস্কৃতির বিষয়গুলো নিয়ে ফেইসবুকের সঙ্গে কার্যকর আলোচনা করে, তবে আমার বিশ্বাস এর সমাধানটি আমরা খুঁজে পাবো। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমেরও একটি জরুরি ভূমিকা আছে। বাংলাদেশে প্রথম সারির প্রায় সব গণমাধ্যমেরই ভেরিফাইড ফেইসবুক পেইজ আছে। এই পেইজগুলোতে যে সংবাদ শেয়ার করা হয়, তার মধ্যে কিছু সংবাদ আমরা পাই যেখানে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি নানা ধরনের কুৎসিত মন্তব্য করে, যেগুলো ফেইসবুকের বর্তমান কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের পরিপন্থী। বিক্ষিপ্তভাবে আমরা অভিযোগ জানালেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো কাজ হয় না। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো যদি তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পেইজ বা চ্যানেলগুলোর মন্তব্যঘর তদারকি করেন এবং হিংসাত্মক, অবমাননাকর ও জীবননাশের হুমকিসহ আইন বহির্ভূত মন্তব্য ও তার ব্যবহারকারী সম্পর্কে ফেইসবুকে অভিযোগ করেন, তবে ফেইসবুকের একটি দাপ্তরিক দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। অন্যদিকে গণমাধ্যম কর্তৃপক্ষ যদি বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ীও ব্যবস্থা নেন, তবে উক্ত ব্যবহারকারীর আইডি বন্ধের জন্য হলেও সরকার ফেইসবুকের সঙ্গে যোগাযোগ করবে, সেক্ষেত্রেও একটি রাষ্ট্রীয় চাপ তৈরি হবে ফেইসবুকের ওপর।
জনাব অমি রহমানের পিয়ালের লেখার মন্তব্য ঘরে অনেকেই আন্তর্জাতিক আদালতে যাবার বিষয়ে বলেছেন। প্রয়োজন হলে সে রাস্তাও অবলম্বন করতে হবে। কারণ তারা যদি কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের দোহাই দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্বলিত আলোকচিত্র মুছে দেয় কিংবা বিধান প্রয়োগের নামে দ্বিচারিতা প্রদর্শন করে, তবে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক আদালতে যেতেই হবে। এখনই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে না নিলে ভবিষ্যতে পথ হারানোর সম্ভাবনা প্রবল।