বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিতর্কের মহাবাদলের সামনে কী তপোক্লিষ্টই না দাঁড়িয়ে থেকেছি আমি। বিতর্ক তখন আমার কাছে এক মুনস্ট্রাক অরণ্য—তাকে দেয়া যায় না কিছুই, কেবল নিয়ে আসা যায় ঢের। আমার বলশেভিক চোখে বিতর্কের চক্ষুদান পর্ব সমাপ্ত হবার পর আমি জেনে গেছি শতাব্দীর পর শতাব্দী কিছু সব্বনেশে খশড়া জমা হয়েছে মানব জাতির ভল্টে। অতএব বিতর্ক থেকে বেরোনোর প্রশ্নই ওঠে না, বরং আরও বেশি করে তাতে বাঁধা পড়া যেতে পারে মগজের জীবনানন্দীয় কোষের তাগিদেই।
এই ছোট্ট ভূমিকাটি দিলাম, কেননা লিখতে বসলেও শেষ পর্যন্ত বিতর্কই জিতে যায়। বিতর্ক জিতে যাবে কারণ এখনও প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমেই সভ্যতার পথরেখা নির্মিত হয়। ‘আলু’ আর ‘আলুবোখরার’ মধ্যে বিরোধহীন পার্থক্য যেমন স্পষ্ট, ‘মত’ আর ‘দ্বিমতের’ ক্ষেত্রেও তাই। সংসদীয় বিতর্ক আমাদের শিখিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উত্থাপিত বিষয়টিও চ্যালেঞ্জযোগ্য এবং প্রধানমন্ত্রী তাতে রাগ করেন না। প্রস্তাবটি চ্যালেঞ্জ করে বিরোধিদলীয় নেতা একটি নতুন প্রস্তাব দেন। আলোচনা চলে, বিতর্কের পথ ধরে একটি নতুন পথের দিকে অগ্রসর হই আমরা। হায়! লুই কানের অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দারা এটা জানলোই না। অতএব ‘বাঙালি জাতির সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি’র স্বরূপ উদ্ঘাটনের আগে আমরা যদি নির্দ্বিধায় ঘোষণা করি যে, এই উদ্ধৃতিচিহ্নের অন্তর্ভুক্ত বাক্যাংশ আসলে পরস্পরবিরোধি; তাহলে সম্পাদক নিশ্চয়ই লুই কানের অ্যাপার্টমেন্টবাসীদের মতো রাগ করবেন না। সম্পাদকের কলম রামধনু ছড়ানোর আগে আমরা সবিনয়ে এটুকুও জানিয়ে রাখতে চাই যে, অতীত বর্তমান এমনকি ভবিষ্যতেও এই সৌহার্দ্য সম্প্রীতির প্রশ্নে আমাদের ‘জাতিগত’ ধারণা দেয়ালে ঝুলানো পুরোনো ক্যালেন্ডারের মতোই অস্বস্তিকর ও অকার্যকর হয়ে থাকবে। অথবা আমরা একটি বিপ্লবের মুখোমুখি হতে পারি। আমরা আমূল বদলে নিতে পারি এগুলোর অর্থ। এগুলো বলতে— ‘জাতি’, ‘জাতীয়তাবাদ’ বা এইসব অর্থে আমরা যে শব্দগুলো ব্যবহার করি। নতুন একটি সংজ্ঞায়ন হতে পারে, এমনকি এটা জেনেও হতে পারে যে ফরাসী দার্শনিক রেনাঁ বা রবীন্দ্রনাথও নিজ নিজ ভাষার ক্ষেত্রে এর সংজ্ঞায়ন করে গেছেন। বর্তমানেও ‘জাতি’ অর্থে নেশন এবং ‘জাতীয়তাবাদ’ অর্থে ন্যাশনালিজম নিয়ে বিস্তর কাজ চলছে; অ্যান্টি ন্যাশনালিজম ধারণাও এখন সমান তালে আলোচিত হচ্ছে। নৃতাত্ত্বিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি প্রায় প্রতিটি দৃষ্টিকোণ থেকেই ‘জাতি’ ধারণাটি ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হলেও, তা আদতে এমন কেনো সুনির্দিষ্ট বিন্দুতে এসে উপনিত হচ্ছে না—যেটি মানবিক। ফলে যতো ভালোভাবেই শুরু হোক না কেনো জাতিগত ধারণা শেষ পর্যন্ত একটি ফ্যাসিবাদী ধারণায় পর্যবসিত হচ্ছে এবং আমরা বুঝতে পারছি কী ভয়াবহ জাতিগত উন্মাদনার সৃষ্টি হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে। কার্যত সে কারণেই চলমান নিবন্ধে বর্তমান লেখক তার নিজস্ব ধারণার আলোকে সম্পাদকের বাছাইকৃত বাঙালি জাতির সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির স্বরূপ: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিষয়ে আলোচনা করবেন। তবে এই আলোচনা মোটেও প্রশ্নাতীত নয়; বরং অনেক বেশি প্রশ্ন দ্বারা এর ঋদ্ধ হবার বাসনা প্রবল।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, ‘জাতি’ বা ‘জাতীয়তাবাদ’ ধারণাটি একটি দর্শন-অনুসৃত বিষয় হতে পারে। স্বাধীন অস্তিত্বের দর্শন—সোজা বাঙলায় স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল থাকার দর্শন। গোটা পৃথিবীতে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল প্রতিটি জনগোষ্ঠী এই টিকে থাকার সংগ্রামে একটি ঐক্যবদ্ধ মিছিলে সামিল হতে পারেন। তাদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বা নৃতাত্ত্বিক পরিচয় যা-ই হোক না কেনো, স্বাধীন অস্তিত্বের প্রশ্নটিই তাদের কাছে মুখ্য। এই ‘স্বাধীন’ শব্দটির নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক বয়ান থাকতে পারে। কারও কাছে এই স্বাধীনতা মানে হতে পারে সার্বভৌমত্ব (যেমন বাঙালি), কারও কাছে মনে হতে পারে এটি হলো নিজস্ব অধিকারের সবটুকু সমুন্নত রেখে সম্মানের সঙ্গে একত্রে বসবাস (যেমন বাঙলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন নৃ-জনগোষ্ঠী) আবার কারও মনে হতে পারে একটি অর্থনৈতিকভাবে গতিশীল কাঠামোতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের ভিত্তি (যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্র)। বস্তুত ‘স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল’—জাতি অর্থে এই ধারণার আলোকেই নিবন্ধের বাকি অংশের আলোচনা করা হলো।
দুই
বাঙালি জাতির সৌহার্দ্য সম্প্রীতির অতীত কতোদিনের? শ্রদ্ধেয় নীহাররঞ্জন রায়ের দ্বারস্থ হলে আনুমানিক ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে। গবেষক অতুল সুর ভারি চশমার কাঁচ মুছে আরও পরিস্কার উত্তর দেবেন শশাঙ্কের শাসনামল থেকে শুরু করে পাল, সেন, সূফী, সুলতান, তুর্কী, মুঘল এবং নবাব শাসনামল পর্যন্ত। কিন্তু অতো বিস্তৃত বা বিক্ষিপ্ত আলোচনা নয়; বরং স্বাধীন অস্তিত্বের ধারণাপ্রসূত জাতিগত চিন্তায় উনিশ ও বিশ শতকের একটি বন্ধনী-বদ্ধ সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের আলোচনা হতে পারে। মনে রাখতে হবে, যে সময়টির কথা বলছি, তখন ব্রিটিশ রাজত্ব চলছে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনামলের শুরু থেকেই বাঙালি তার জনপদে বিরাজমান সংস্কৃতি-সাহিত্য-দর্শন সম্বন্ধে যেমন সচেতন ছিলো, তেমনি তার জানালা খোলা ছিলো পাশ্চাত্য দর্শনের জন্যেও। কিন্তু বিপত্তির জায়গাটি ছিলো (বস্তুত এখনও আছে) প্রথা ও সংস্কার থেকে দর্শনকে আলাদা করা যায়নি। আবার প্রতিটি সমাজে প্রথা বা সংস্কারের তীব্রতা নির্ণীত হয় সেগুলো পালনকারী জনগোষ্ঠীর সামাজিক অবস্থানের প্রেক্ষিতে। সুতরাং সনাতন ধর্মে বিরাজমান যে সাংস্কৃতিক সৌন্দর্য, তা আপামর বাঙলার সৌন্দর্য হয়ে উঠতে পারলো না। দূর্গাপূজা কেবল হিন্দুধর্মাবলম্বীদের উৎসব হয়েই রইলো, বাঙালির সার্বজনীন উৎসব হয়ে উঠলো না। এজন্য একদিকে যেমন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শ্রেণি-চেতনা-দুষ্ট মানসিকতা দায়ি; অন্যদিকে দায়ি মুসলমানদের আত্ম-পরিচয়ের সংকট। ফলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো অনন্য চেতনার মানুষকে যেমন এই অঞ্চলের মুসলমান গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করলো, তেমনি রামমোহন রায়ের মতো সুবিধাবাদী সমাজসংস্কারক, বঙ্কিমচন্দ্রের মতো সাম্প্রদায়িক সাহিত্যিক ও শেষে এসে রবীন্দ্রনাথের মতো মোটামুটি মানের অসাম্প্রদায়িক একজন মানুষকে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা একেবারে দেবতার আসনে বসিয়ে দিলো। আমাদের সামাজিক মনোচেতনায় বিদ্যাসাগর বাদ পড়লেন, সাংস্কৃতিক চৈতন্যে লালন বাদ পড়লেন; আর সবখানে প্রবল প্রতাপে টিকে গেলেন রামমোহন-বঙ্কিমের মতো সুবিধাবাদী সাম্প্রদায়িক ও রবীন্দ্রনাথের মতো দ্বিধাগ্রস্থ মহাপুরুষ। একানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, ব্যক্তিগতভাবে আমি মোনে করি, এই অঞ্চলে ইসলাম ধর্ম হিশেবে আসেনি, এসেছে রাজনীতি হিশেবে। পারস্য বা অন্যত্র ইসলামের বিকাশ ও এই অঞ্চলে ইসলামের বিকাশ— এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট। যেহেতু সনাতন ধর্মে সে সময়ে বর্ণ-বিদ্বেষ ছিলো প্রবল, সেহেতু নিম্নবর্নের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অমানবিক জীবনযাপন করতে হয়েছে। বস্তুত এই সুযোগের সদ্ব্যবহারই করেছিলো ইসলাম। যেহেতু ধর্ম হিশেবে ইসলাম তুলনামূলকভাবে কম বয়ষ্ক, সেহেতু টিকে থাকার জন্যেই এর রীতিনীতি খানিকটা উদারনৈতিক করা হয়েছে। অন্যদিকে সূফী-দর্শন, বাউল-দর্শন ইত্যাদি মানবিক দর্শনের প্রভাবে এই অঞ্চলে ইসলাম বিস্তার লাভ করেছে মানবতার বাণী নিয়েই। সহজেই তা নিম্নবর্ণের নির্যাতিত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আকর্ষণ করেছে। ফলে নিপীড়িতদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিলো ইসলাম। কিন্তু সামজিক শ্রেণি-চেতনার বিরোধ রয়েই গেলো। ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের কারণেই হোক আর জমিদারদের অধিকাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী হবার কারণেই হোক— ব্রিটিশদের কাছে তাদের একটি শক্ত অবস্থান তৈরি হলো। অর্থাৎ হিন্দু আধিপত্যবাদ টিকে থাকলো। ফলে ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলমান হওয়া অন্ত্যজ শ্রেণির লাভের লাভ কিচ্ছু হলো না উল্টো ধর্ম পরিবর্তনের জন্যে তারা সামাজিক নিপীড়নের শিকার হলো।
ইতিহাস অনেকটা এভাবেই আলোচনা করলেও সেখানে বাদ পড়ে গেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ—তা হলো তৎকালীন জনগোষ্ঠীর মনস্তত্ত্ব। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, সে সময়ের জনগোষ্ঠীর মনস্তত্ত্ব তীব্রভাবে দ্বিধগ্রস্থ ছিলো। নব্য মুসলমানরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলো টিকে থাকার জন্য, ফলে তাদের মাঝে ইসলাম ধর্মীয় চেতনাবোধ জাগ্রত হবার কোনো কারণ ছিলো না। অন্যদিকে দলে দলে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা নিপীড়িত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় সনাতন ধর্ম সম্বন্ধে কট্টরবাদীদের মোনেও সংশয় তৈরি হয়েছিলো। এর সপক্ষে আমি প্রমাণ দিতে পারবো না, তবে ঘটনা বিশ্লেষণে এই ধারণা তৈরি হয়েছে। সুতরাং দুই জনগোষ্ঠী শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হলো। সেটা যেভাবেই হোক, তাদের টিকে থাকতে হবে। এই দুই জনগোষ্ঠীর বাইরে অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর ইতিহাসও আলোচনায় আনা যেতে পারে। লক্ষ্যণীয়, তাদের মাঝেও টিকে থাকার সংগ্রাম ছিলো প্রবল। ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন দমননীতির বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের আলেখ্যই তার প্রমাণ। অতএব, মোটা দাগে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল থাকার একটি সংগ্রামমুখর উনিশ ও বিশ শতক আমরা প্রত্যক্ষ করি। একই সঙ্গে প্রত্যক্ষ করি ব্রিটিশ সরকারের ধর্মকেন্দ্রীক রাজনীতি। মুসলমান জনগোষ্ঠী, বলা বাহুল্য মুসলমানদের তৃতীয় বা চতুর্থ প্রজন্ম যখন বুঝলো টিকে থাকার জন্য ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে, তখন তারা তা-ই করলো। অতএব, ব্রিটিশ আনুগত্য লাভের ক্ষেত্রেও হিন্দু-মুসলমানের একটি প্রতিযোগিতামূলক অবস্থা তৈরি হলো। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হলো, ১৯১১ সালে তা রদও হলো। কিন্তু এই ঘটনা দুই জনগোষ্ঠীর মুখোমুখি অবস্থানকে আরও পোক্ত করে তুললো।
এসবের পরও একটি সাংস্কৃতিক স্রোত গোটা বাঙলায় প্রবহমান ছিলো। সূফী-দর্শন, বাউলতত্ত্বসহ প্রথা-সংস্কাররহিত একটি মানবিক দর্শন সমাজে ক্রিয়াশীল ছিলো। এই দর্শনই মূলত সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সেতু রচনা করেছিলো তৎকালীন জনগোষ্ঠীর দ্বিধান্বিত মানসিকতায়। কিন্তু মূল রাজনীতিতে তার প্রভাব ছিলো সামান্যই, কেননা, চরিত্রহীন রাজনীতি চেষ্টা করলেই তার অনুকূলের কিছু দর্শনকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। ফলে লালন যতোটা না উচ্চারিত হলো, তার চেয়েও বেশি উচ্চারিত হলো রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে নজরুলের জয়গান। ফলে আবহমান সমাজে সম্প্রীতির যে ঢেউ, তা মধ্যবিত্ত বা নাগরিক সমাজে এসে লাগলো না। তারা চলতে লাগলো রাজনীতির চালে। দাঙ্গা-হত্যা-রক্তপাতের পর তারা বুঝতে পারলো হিন্দু-মুসলমানের আর একসাথে থাকা চলে না, তাদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন প্রয়োজন। কিন্তু একবারের জন্য বুঝতে চাইলো না, এর পেছনের রাজনীতিটা কী। টাটা-বিড়লা বা আদমজী-ইস্পাহানিদের স্বার্থটা কী। নেহেরু বা জিন্নাহর ধর্মভিত্তিক কচকচানির আড়ালে খেলা করা লোভ কারও চোখে পড়লো না। অতএব, সাতচল্লিশে আবার দেশভাগ হলো। বাঙালি নাচতে নাচতে তার শিকড়ের অর্ধেকটা এক পাড়ে রেখে অন্য পাড়ে এসে মুসলমানের পাকিস্তান বানালো। বাঙালি জাতির টিকে থাকার লড়াই শেষ পর্যন্ত মুসলমান জাতির টিকে থাকার লড়াইয়ে এসে উপনিত হলো এবং তারা বিশ্বাস করলো, মুসলমান-মুসলমান এক রাষ্ট্রে থাকলে সুদিন আসবে। সুদিন আসেনি। সাতচল্লিশের আহাম্মকির খেসারত দিলো তেইশ বছর পাকিস্তানি গোলামি করে। বলাই বাহুল্য, বাঙলা ভাগের মাত্র এক বছরের মাথায় বাঙালি তার ভুল বুঝলো যখন পাকিস্তানিরা ভাষার প্রশ্নে খবরদারি চাপাতে শুরু করলো। ধর্মের ভাবালুতা কেটে গেলো, বুঝতে পারলো, উর্দূ রাষ্ট্রভাষা হলে সে আবার অস্তিত্বের সংকটে পড়বে, কারণ তার মাতৃভাষা বাঙলা। অতএব রাষ্ট্রভাষার দাবি থেকে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বাঙালি স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে এলো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। এই পুরো সংগ্রামই বাঙালি করেছে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল থাকার জন্যেই। সুতরাং যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পাকিস্তানের প্রশ্নে একসময় নির্যাতন করেছে মুসলমানরা— স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে সে বুঝলো, টিকে থাকতে হলে ধর্মের বিভেদটা ভুলে যেতে হবে। মজার বিষয় হলো, এই উপলব্ধি কিন্তু সমাজের সে-ই মধ্যবিত্ত নাগরিক শ্রেণির, যারা অত্যুৎসাহী হয়ে দেশভাগে সায় দিয়েছিলো রাজনীতিটা না বুঝেই। এখানেও সমাজের অভ্যন্তরে ক্রিয়াশীল ছিলো সে-ই বাউল-সূফী দর্শন— নীরবে এবং সমাজের তথাকথিত অন্ত্যজ শ্রেণিতে। যাই হোক, ইতিহাস মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে লিখিত হয়। অতএব, টিকে থাকার লড়াইয়ে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া জাতি নিজেদের অসাম্প্রদায়িক ভাবতে শুরু করলো। কিন্তু বিষয়টা তা ছিলো না। পাকিস্তানি অত্যাচার নিপীড়ন আর গণহত্যার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ জাতি নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নেই ধর্ম-বর্ণ সব ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো। আমরা যদি স্বাধীনতাবিরোধি অপশক্তিগুলোর ইতিহাস দেখি, তবে স্পষ্ট বোঝা যাবে কীভাবে ইসলামি দলগুলো ধর্মকে ব্যবহার করে গণহত্যা, বিভৎস নারী নির্যাতন করেছে। তারা কিন্তু হিন্দু-মুসলমান বিবেচনা করেনি, তার বিবেচনা করেছে ‘বাঙালি জাতি’কে, যেহেতু বাঙালি স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল থাকার লড়াইয়ে অবতীর্ণ। একারণেই বাঙালি জাতির প্রধানতম শত্রু হলো এই যুদ্ধাপরাধীরা, কারণ তারা বাঙালি জাতির অস্তিত্বশীল সংগ্রামকে নিপীড়নের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলো।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ যে কোনো বিচারে পৃথিবীর একটি মহত্তম ঘটনা। দর্শন বা তত্ত্বগত বিচারে তো বটেই। কথাটি দায়িত্ব নিয়ে বলছি। রুশ বিপ্লব বা ফরাসি বিপ্লবের মতো অনন্য ঘটনার তাত্ত্বিক প্রচারপত্রগুলোর সঙ্গে বাঙলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে পাশাপাশি রেখে পাঠ করলে আগ্রহী পাঠকগণ আমার এই আত্মবিশ্বাসের কারণ বুঝতে পারবেন। প্রথমোক্ত দুটো ক্ষেত্রেই, জাতিগত ধারণার এমন একটি সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে, যা কালের বিবর্তনে আজ আর টিকছে না। কিন্তু বাঙলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে তিনটি ধারণা ব্যবহার করে জাতি ধারণাটির একটি কালোত্তীর্ণ সংজ্ঞায়ন করা হয়েছে। তীব্র থরোথরো তিনটি ধারণা— ‘সাম্য’, ‘মানবিক মর্যাদা’ ও ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’। আমরা বলতে পারি, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের এই তিনটি ধারণা সম্বলিত সাতাশ ও আটাশ নম্বর বাক্যগুলো উনিশ ও বিশ শতকের বাঙালি জাতির সৌহার্দ্য সম্প্রীতির ইশতেহার।
তিন
মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাঙলাদেশে আমাদের সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় হওয়া উচিৎ ছিলো। কারণ মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সার্বিক চৈতন্যের পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু যেহেতু ‘জাতি’ ধারণার একটি সংকীর্ণ রূপ আমাদের মগজে বিরাজ করছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকেই, সেহেতু আমরা তা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। বাহাত্তরের সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আংশিকভাবে প্রতিফলিত হয়; মূল চার স্তম্ভে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ আবারও আমাদের সৌহার্দ্যের মানচিত্রে আধিপত্যবাদের কালিমা ছড়ায়। তবে বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর—এই সময়ে বাঙলাদেশের শাসনব্যবস্থায় যে পরীক্ষামূলক দর্শনগত চর্চা বঙ্গবন্ধু করছিলেন, তাতে ধারণা করা যায়, এই সমস্যা থেকে আমরা বের হতে পারতাম। কিন্তু পঁচাত্তরে জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কফিন বন্দী করে সামরিক অপশক্তি। পাকিস্তানপন্থিরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় এবং রাজনীতিতে পাকিস্তানি বর্বর সাম্প্রদায়িক অপ-দর্শনের বিস্তার ঘটাতে থাকে। এখানেও সে-ই একই সত্যের পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন বোধ করছি যে, নানাভাবে ক্ষত-বিক্ষত পঁচাত্তর পরবর্তী বাঙলাদেশেও সে-ই বাউল-লোকদর্শন ও সূফীতত্ত্বের প্রভাব বিরাজমান ছিলো। একদিকে ধর্মের রাজনীতি, অন্যদিকে মানবতার জন্য ধর্ম—শেষ পর্যন্ত এই দুই সমীকরণে বাঙলাদেশে সৌহার্দ্য সম্প্রীতির লেখচিত্র এগুতে থাকে। আমাদের রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীনতা ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করতে শুরু করে এবং ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি শাসনামলের মতোই ‘সংখ্যাগুরু’ ‘সংখ্যালঘু’ ধারায় রাজনীতি এগুতে থাকে। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীর মাঝে এক ধরনের অবিশ্বাস তৈরি হয়। বাঙালির সার্বজনীন উৎসবগুলোও ধর্মের মোড়কে প্রচার করতে থাকে সাম্প্রদায়িক অপগোষ্ঠীগুলো। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের কারণে এই সমস্যা আরও বাড়ে। একদিকে ধর্মীয় উন্মাদনা এবং ধর্ম দিয়ে জনগোষ্ঠীকে বিচারের প্রবণতা; অন্যদিকে সংকীর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত জাতিগত দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেদের মোড়ল প্রমাণ করার অপচেষ্টা। ফলে বাঙলাদেশের ভূ-খণ্ডে বসবাসরত অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর ওপর বাঙালির নানাবিধ নির্যাতন শুরু হয়। যে বাঙালি একসময় নিজেই আধিপত্যবাদের শিকার হয়ে লড়াই করেছে সবাইকে সাথে নিয়ে, সে-ই বাঙালি রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে আজ হয়ে উঠেছে আধিপত্যবাদী। কারণ কী? কারণ হলো—বাঙালি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুসৃত যে সমাজ গঠনের দর্শন, তা থেকে ছিটকে সরে এসেছে এবং হয়ে উঠেছে একটি দর্শনরহিত দানব। ধর্মীয় পরিচয়কে মুখ্য করে তোলা হয়েছে রাজনীতি এবং ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিলের জন্য। হিন্দু সম্পত্তি গ্রাস করার জন্য তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তাদের উদ্বাস্তু করা হচ্ছে। বৌদ্ধ বিহারে হামলা করা হচ্ছে। আর এসবই করা হচ্ছে একাত্তরের পর খুচরো আবর্জনার মতো টিকে যাওয়া পাকিস্তানপন্থি দলগুলো, যারা পঁচাত্তরের পর রাজনৈতিক রসদ গ্রহণ করে এখন ফুলে ফেঁপে উঠেছে। কারণ রাজনীতি এখন আর দর্শনকেন্দ্রীক (পড়ুন মুক্তিযুদ্ধের দর্শন) নয়; বরং হয়ে উঠেছে ভোটমুখী। এক দশক আগেও এই ভোটমুখী রাজনীতিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রভাব ছিলো, এখন নেই; যারা নির্বাচিত হবার জন্যে হিন্দুদের ভোটের ওপর নির্ভর করতো, তারাও এখন সেটা নিয়ে ভাবেন না। এই না ভাবার পিছনেও কিন্তু কাজ করেছে একাত্তরের পরাজিত শক্তি। তারা জানতো, সব হিশেব শেষ হলেও ভোটের প্রশ্নে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি গুরুত্ব থাকবে। সেক্ষেত্রে তাদের পাকিস্তানি মতবাদ (মুসলমান-নির্ভর রাষ্ট্রতত্ত্ব) প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না। তাই তারা কৌশলে এই ভোটব্যাংকগুলো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেয়। যশোরের মালোপাড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, সাতক্ষীরা বা গাইবান্ধা, রাজশাহী এলাকায় একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে সেখানকার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের এলাকাছাড়া ও দেশছাড়া করে দেয়। মোট জনগোষ্ঠীর তুলনায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভোটারদের অনুপাত কমে আসে। ফলে ১৯৯৬, ২০০১ বা ২০০৮ সালের নির্বাচনে যে রাজনৈতিক দল এই অঞ্চলের হিন্দু ভোটারদের ভোটের দিকে তাকিয়ে তাকতো, তারাও জানে, এখানকার ভোট এখন আর ‘ট্রাম্প কার্ড’ হিশেবে কাজ করবে না। সুতরাং হিন্দু-সম্পত্তি গ্রাস করার মহোৎসবে মুসলমানের পালে হাওয়া দেয়াই ভালো। বর্তমান সরকার তা-ই করছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দুরাচারের কারণে ভিন্নমত হয়ে উঠছে একটি বিষফোঁড়া। দ্বিমত পোষণ করা এবং অন্যের দ্বিমত হবার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াও সম্প্রীতির পূর্বশর্ত। সমাজ কখনও একটি বিশেষ মত বা দর্শনকে অবলম্বন করে চলতে পারে না। কিন্তু সেটাই করানোর চেষ্টা চলছে। ফলে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে, দীর্ঘ এতো বছরে সম্প্রীতি সৌহার্দ্যের লেখচিত্র নিম্নমুখী এবং আনুভূমিক রেখার সঙ্গে খুব সামান্য দূরত্বে সমান্তরাল।
চার
এই সামান্য দূরত্বটুকুই বাঙালি জাতির সৌহার্দ্য সম্প্রীতির ভবিষ্যৎ স্বরূপটি নির্মাণ করবে। পুরো আলোচনায় একটি বিশেষ দিক লক্ষ্যণীয় যে, স্বাধীনভাবে অস্তিত্ব রক্ষার যে জাতিগত সংজ্ঞায়ন করা হলো, তার বাঙলাদেশ প্রেক্ষিতে দুটো স্রোত ক্রিয়াশীল—এক, বাউল, লোক-দর্শন, সূফীতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব ইত্যাদি দর্শনগত শক্তি, যা বহু বছর ধরে ক্রিয়াশীল; দুই, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দর্শন, যা মূলত ধর্মকে ব্যবহার করছে রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়ে একটি প্রতিক্রিয়াশীল সমাজ গঠনের জন্য। এর বাইরে আর যা কিছু তা হলো বাঁদর নাচ। হাততালি আর পয়সা কামানোর ধান্ধা। খুব গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে, ধর্মবাদী রাজনীতি প্রায়শই চড়াও হয় আমাদের লোক-দর্শনপ্রসূত সংস্কৃতির ওপর। লালন শাহ পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ যান, রবীন্দ্রনাথ চিহ্নিত হন হিন্দু কবি হিশেবে, নজরুল পাঠ করা হয় সচেতনভাবে তার শ্যামা-সঙ্গীতগুলো বাদ দিয়ে, দূর্গাপূজা-নববর্ষের মতো সার্বজননী উৎসবগুলো প্রচারিত হয় হিন্দুয়ানি উৎসব হিশেবে। বাউল ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়, সূফী সাধকদের ওপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। উপরিতল থেকে এসব দেখে বাঙালি কখনও প্রতিবাদ করে, কখনও নীরব থাকে এবং মাঝে মাঝে অন্যান্য নৃ-গোষ্ঠীর জনসাধারনের ওপর উর্দিধারী সেটেলারগিরি দেখিয়ে আসে। কালের বিবর্তনে বাঙালি কতোটা নগ্ন মানসিকতার হলে নিজেদের নামকরণ করেছে ‘সেটেলার’।
আমাদের সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নির্ভর করছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্নে অটল অবস্থানকে ঠিক কতোদিনে আমরা আমাদের প্রকৃত অবস্থান হিশেবে নিশ্চিত করতে পারবো। এর আগ পর্যন্ত কিছু অন্তঃসারশূন্য বাক্যমালাই হতে থাকবে আমাদের সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সমাজস্বীকৃত বালখিল্য নিদর্শন।