পনেরোই আগস্ট ১৯৭৫।
এক ঘোর কৃষ্ণপক্ষ নেমে এসেছিল বাঙলাদেশের বুকে। জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার যে নারকীয় ঘটনা সেদিন ঘটেছিল, তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকেই বাঙলাদেশে সবচেয়ে প্রচলিত কথা হচ্ছে, “কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল।” সন্দেহ নেই, এ কথাটির মাঝেই রয়েছে একটি বড়ো রকমের ফাঁকি। কারণ, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, বেতার ও টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ, তৎকালীন পুলিশ প্রশাসন সকলেই তখন নতজানু নীতি নিয়েছিল বলেই এমন ট্র্যাজিডি ঘটেছিল বাঙলার বুকে।
এমনকি প্রশ্ন থেকে যায় গণমাধ্যমকে নিয়েও। পনেরোই আগস্টের আগে ও পরে গণমাধ্যমের সংবাদ পরিবেশন ও সাংবাদিকতা নীতির ধারাবাহিকতা দেখলে আমাদের চোখ কপালে ওঠার কথা। বলতে দ্বিধা নেই, ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতার’ নামে বাহাত্তর থেকেই তৎকালীন সংবাদপত্রগুলো যে ধারায় সংবাদ পরিবেশন শুরু করেছিল, তার নজির একটি সদ্য-স্বাধীন দেশে বিরল। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট ও ১৫ আগস্টে একই পত্রিকার সংবাদভাষ্য দেখলে যে কোনো সুস্থ মানুষের চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। সাংবাদিকতার শিক্ষার্থীরা হয়তো বলবেন, এটাই সংবাদপত্রের নীতি; যদি তা-ই হয়, তবে সাংবাদিকতা না-জানা মানুষ হিসেবে আমার বক্তব্য হলো, এমন নীতি পাশবিকতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার দৃষ্টান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠান যদি ‘ক্লিন চেক’ পেয়ে থাকে, আমার মতে, সেটা গণমাধ্যম। কারণ আমরা যখন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিশনের দাবি করি, তখনও গণমাধ্যম নিজেকে আওতার বাইরেই রাখে।
এর প্রধান কারণ, গণমাধ্যমই সংবাদপ্রকাশের দায়িত্ব একা পালন করে এসছিল গত কয়েক দশক। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ব্লগভিত্তিক লেখালেখি শুরু হওয়ার কারণে, বিকল্প মাধ্যম তৈরি হয়েছে। ফলে গণমাধ্যমের ঐতিহাসিক ভুলগুলো নিয়ে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
কিন্তু এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, জনমনস্তত্ত্ব তৈরিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা পালনের যে ক্ষমতা, ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্টের পর, তার অপব্যববহারই করেছিল তৎকালীন গণমাধ্যমগুলো।
এ লেখায় সে সময়ের জনপ্রিয় দুটো বাঙলা গণমাধ্যম নিয়ে আলোচনা করা হবে। দৈনিক বাংলা ও ইত্তেফাক তৎকালীন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সম্পাদকীয় নীতি, চিন্তাধারা, সংবাদ পরিবেশনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ফারাক থাকলেও, পত্রিকা দুটোর পনেরোই আগস্ট পরবর্তী কয়েকটি সংখ্যা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা হত্যাকারীদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার কাজটিই করেছিল প্রকাশ্যে। যারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলেন, তারা জেনে অবাক হবেন, দুটো পত্রিকার একটিতেও সেদিন হত্যাকাণ্ডের সামান্যতম প্রতিবাদ হয়নি। একটি প্রতিবেদনও করা হয়নি এই মর্মে যে, রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে খুন করা হয়েছে; কোথাও বলা হয়নি, একজন শিশু ও প্রসূতি নারীকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। খবরের কাগজের স্বাধীনতা তখন কেমন ছিল, তার স্পষ্ট নজির পাওয়া যায় এখান থেকেই। একটি হত্যাকাণ্ডের সামান্য প্রতিবাদটুকুও তারা করতে পারেনি—না সংবাদভাষ্যে, না সম্পাদকীয় উপ-সম্পাদকীয়তে।
প্রথম পাতাজুড়ে অমাবস্যা
দুটো পত্রিকার প্রথম পাতাতেই খুনী খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের সংবাদ প্রধান শিরোনাম হয়েছে। দুটো পত্রিকার শিরোনামেই দেখা যাচ্ছে, সশস্ত্রবাহিনীর আনুগত্য প্রকাশ বা শাসনক্ষমতায় তাদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে সচেতনভাবেই জনগণকে জানানো হচ্ছে। আমার মতো একজন সামান্য মানুষও বুঝতে পারেন, ১৬ আগস্ট সংবাদ শিরোনাম যদি হতে হয়, তাহলে হবে রাষ্ট্রপতি নিহত। এরপর নতুন রাষ্ট্রপতি কে বা কারা শাসনক্ষমতা দখল করেছে, সেটা উঠে আসতে পারে। কিন্তু দুটো পত্রিকারই প্রথম পাতায় রাষ্ট্রপতির সপরিবারে নিহত হওয়ার সংবাদটিই নেই।
প্রথম পাতায় সংবাদ প্রকাশে দৈনিক ইত্তেফাক আবার এক কলম এগিয়েছিল। মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণের সংবাদটির শিরোনামে তারা লিখেছিল, “দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি উচ্ছেদ। সুবিচার ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষণা।”
সুবিচার আর মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার বলিহারি! নিজেদের সংবাদপত্রে তারা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে হত্যার সংবাদটি দিতে পারেনি, বিচারের তো দূরের কথা, তারাই আবার সুবিচার আর মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার গান গাইছে! খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা গ্রহণের সংবাদে তারা একবাক্যে লিখেছে ক্ষমতা গ্রহণকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি নিহত হয়েছেন; কিন্তু সেটা কারা করলো? তিনি সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন, এমনকি শিশুও নিস্তার পায়নি ঘাতকদের হাত থেকে—এসব তথ্য কোথাও নেই। এমন নির্লজ্জ সাংবাদিকতার উদাহরণ পৃথিবীতে আর আছে বলে মনে হয় না।
দুটো পত্রিকার প্রথম পাতাতেই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে, একসঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের ছবি বক্স আইটেম হিসেবে ছাপা হয়েছিল—ইত্তেফাক ছেপেছিল দুই কলামে আর দৈনিক বাংলা তিন কলামে।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট প্রকাশিত পত্রিকা দুটোর সংখ্যার সঙ্গে একটু তুলনা করলে গণমাধ্যমের রাজনৈতিক ডিগবাজী খাওয়ার প্রবণতা কত প্রকট, সেটা উঠে আসে। ১৫ আগস্ট সকালে প্রকাশিত দুটো সংবাদপত্রেই বঙ্গবন্ধু প্রধান খবর এবং সংবাদ-ভাষ্যে তারা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুবর রহমান’ কথাটিই ব্যবহার করেছে।
পরদিনই তারা সুর পাল্টে ফেলে কোথাও মুজিবুর রহমান, কোথাও মুজিব আবার কোথাও শেখ মুজিব ব্যবহার করেছে। রাজনৈতিক দাসানুদাস তাহলে এমনই হয়! সংবাদপত্র সবসময়ই তার স্বাধীনতা বা স্বাধীনতাহীনতার জন্য রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রযন্ত্রকে নানাভাবে দায়ি করে থাকে; কিন্তু সংবাদপত্র নিজেই তো তার স্বাধীনতা চায় বলে মনে হয় না। চাইলে সেদিনের পত্রিকাতে তারা অন্তত এ প্রশ্নটি তুলতে পারতো, রাষ্ট্রপতি হত্যাকাণ্ডের পর সংবিধান অনুযায়ী তো উপ-রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়ার কথা। সেখানে খন্দকার মোশতাক কে?
তাছাড়াও, টেলিভিশনে, বেতারে বঙ্গবন্ধুর ঘৃণ্য খুনীরা নিজেদের খুনের কথা স্বীকার করেছিল। সংবাদপত্র তো এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করতে পারতো যে, রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে খুনীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না কেনো?
এটুকু সাহসও যারা সেদিন দেখাতে পারেননি, তারা যদি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বড়ো বড়ো বাতেলা দেন, তবে সেটা হাস্যকর! যারা নিজেরাই কোনো-না-কোনো রাজনৈতিকব্যবস্থার ফুটবল হতে রাজি, তাদের রেফারি বানাবেই বা কে আর মানবেই বা কে?
সম্পাদকীয় ও উপ-সম্পাদকীয়
দুটো পত্রিকাই প্রথম পাতায় বিশেষ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল সেদিনের সেই রাতের চেয়েও অন্ধকার সকালে। দুটো সম্পাদকীয়র শিরোনামও কাছাকাছি। পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে ইত্তেফাক বলেছিল “ঐতিহাসিক নবযাত্রা” আর দৈনিক বাংলা বলেছিল “ঐতিহাসিক পদক্ষেপ”। জানি না, দুই পত্রিকার এই সম্পাদকীয় একই ব্যক্তির লেখা কি না! নাহলে শিরোনামের এমন মিলকে কাকতাল বলে পাশ কাটানোর সুযোগ কই?
দৈনিক বাংলা একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করলেও, ইত্তেফাক প্রকাশ করেছিল দুটো সম্পাদকীয়। দ্বিতীয় সম্পাদকীয়টির শিরোনাম ছিল দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি । কমনওয়েলথ ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের সুপারিশক্রমে বাংলাদেশের চা-শিল্পের পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণের জন্য ব্রিটিশ সরকার যে সাহায্য করবে বলে জানিয়েছে, তা-ই এ সম্পাদকীয়র মূলভাষ্য।
তবে দুটো পত্রিকার সম্পাদকীয় পড়ে এবং সম্পাদকীয় পাতা বিশ্লেষণ করে একটি বিষয় সম্পর্কে মনে প্রশ্ন জাগে। যে কোনো পত্রিকার সম্পাদকীয় পাতা তৈরি হয়ে যায় আগেরদিন বিকেলবেলাই। বিশেষ কোনো কারণ না ঘটলে, উপ-সম্পাদকীয়র লেখাগুলোও থাকে পুনর্নিধারিত। কিন্তু দুটো পত্রিকাতেই কোনো উপ-সম্পাদকীয় ছাপা হয়নি। ধরে নিচ্ছি, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা সেটা না ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু সিদ্ধান্তটি কখন নিয়েছিলেন? বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড তো ঘটেছিল রাতে, তাহলে কি তার আগেই সংবাদপত্রগুলো জানতো, এমন কোনো ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে? কারণ ইত্তেফাকের বাকিসব পাতা তো ঠিকই ছিল। কেবল প্রথম ও শেষ পাতায় পরিবর্তন এসেছিল; পরিবর্তন এসেছিল সম্পাদকীয় পাতায়। এই পরিবর্তনটি তারা কখন করেছিল? ইতিহাসের এ সুলুকটি সন্ধান করা জরুরি।
গণমাধ্যম সকলকে প্রশ্ন করে, সত্য উত্তর খুঁজে বের করে জনগণকে জানায়। এ কারণেই রাষ্ট্রে গণমাধ্যমের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু ঐতিহাসিক নানা পাপে গণমাধ্যমও যে জড়িত, সে সত্যটুকু তুলে ধরার সময় এসেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে বা জাতীয় চারনেতা হত্যাকাণ্ডে গণমাধ্যেমের যে ভাষ্য বা সংবাদ পরিবেশনারীতি—তা সন্দেহজনক এবং গত চারদশকেও এ সন্দেহ দূর করার মতো কোনো সদুত্তর তারা দিতে পারেনি। সুতরাং, সময় এসেছে তাদেরও প্রশ্ন করার—বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে গণমাধ্যমের ভূমিকা কী ছিল?