আজকাল বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সংবাদপত্রে এমনকি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থীদের মধ্যেও যে কথাটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয় তা হলো, এবারের নির্বাচনে নতুন প্রজন্মের ভোটারদের অংশগ্রহণ। জীবনে প্রথমবার ভোটার হতে পারার আনন্দ, দায়িত্ববোধ এবং আসন্ন নির্বাচনে এ বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে একজন নতুন ভোটার হিসেবে লেখাটি লিখছি। আমি জানি, আমার মতো অনেকেরই হয়তো আসন্ন নির্বাচন সম্পর্কে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি কাজ করছে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রচারণাতে যে পরিবর্তনের কথা বলছে, সুন্দর আর সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাচ্ছে- তার অধিকাংশই নির্ভর করছে নির্বাচন-উত্তর পরিস্থিতির উপর। যেহেতু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নির্বাচনের পর “কথা না-রাখা” বেশ সহজ ও স্বাভাবিক ঘটনা, তাই রাজনৈতিক দলগুলোর দেয়া প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে বিভিন্ন মহল বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করছেন। তবে একথা নিশ্চিত যে, সকলেই একটি গ্রহণযোগ্য এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা করছেন।
তবে আমরা যারা এবারই প্রথমবার ভোট প্রদানে অংশগ্রহণ করছি তারা এবারের নির্বাচনটিকে সত্যিকার অর্থেই একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে চাই। এ চাহিদার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো, ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনটি হবার কথা ছিলো আরো দু বছর আগে। জরুরী অবস্থার মধ্যে, মৌলিক অধিকার জলাঞ্জলি দিয়ে অবশেষে আমরা নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। তাই আমরা এ নির্বাচনকে অবশ্যই বিগত নির্বাচনগুলোর মতো হতে দিতে পারি না। ১/১১ সৃষ্টি এবং তার পরবর্তী সময়ে আমাদের যে প্রত্যাশার কথা বলা হয়েছিলো, তার এক-তৃতীয়াংশও বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার পূরণ করতে পারেনি। আমরা ভেবেছিলাম বিগত সময়গুলো যারা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে, হত্যা-সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মধ্য দিয়ে বাঙলাদেশকে একটি চূড়ান্ত ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলো- তাদের বিচার হবে এবং তারা রাজনীতি থেকে বিতাড়িত হবে। কিন্তু দৃশ্যপট সম্পূর্ণ উল্টো। হঠাৎ কী এক অদৃশ্য ইশারায় সরকার তড়িঘড়ি করে সকল আসামিদের নির্বাচনের আগে জামিনে মুক্ত করে দিলো; রাজনীতিতে পুনরায় দুর্বৃত্তায়ন তৈরি হলো এবং সত্যি বলতে এখনো জনগণের ভয়হীনভাবে ভোট দেয়া নিশ্চিত হলো না। সুতরাং নির্বাচনের মৌলিক পরিবেশের বারো আনাই আগের মতো রয়ে গেছে, চার আনা পরিবর্তন হয়েছে মাত্র। এতোকিছুর পরও এ নির্বাচনের সবচেয়ে বড়ো তাৎপর্য হলো, এর একটি বড়ো অংশ আমাদের মতো নতুন ভোটার। সুতরাং যুদ্ধটি এবার আমাদেরই করতে হবে।
আমরা অনেক আশা করেছিলাম, বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে। কিন্তু তারা কেবল বক্তৃতাই দিয়ে গেলেন। এবারো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী। তবে আমি বিশ্বাস করি, এবার এ যুদ্ধাপরাধীদের আমরা দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে পারবো। বাঙলাদেশে এবারই প্রথম নির্বাচন হচ্ছে যেখানে আমরা, মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর প্রজন্ম , একটি বড়ো ভূমিকা পালন করছি। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করতে পারিনি, কিন্তু একাত্তরে যারা এদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলো, সেই নিজামী-মুজাহিদ-কামরুজ্জামান-সাকা চৌধুরী গংকে এবার আমরা ভোটের মাধ্যমে পরাজিত করবো। স্বাধীন বাঙলাদেশে এ অমানুষরা কখনোই নির্বাচিত হতে পারে না, যদি হয়, তাহলে সে নির্বাচন ও তার ব্যবস্থা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে পারে। এবারের নির্বাচনী প্রচারণাতেও সেই যুদ্ধাপরাধীরা সমান তালে মিথ্যাচার করে যাচ্ছে। বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়াতে তাদের ধারণা, গতবারের মতো এবারো তারা উতরে যাবে। আমি জানি স্বাধীন দেশে প্রতিটি মানুষের স্বাধীন রাজনৈতিক সত্তা থাকতেই পারে। তাই যারা বিএনপির কর্মী-সমর্থক রয়েছেন, এবারই প্রথমবার ভোট দেবেন, আপনারা একটু ভাবুন, আপনাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান একজন সেক্টর কমাণ্ডার। তার তৈরি দল কতোটা আদর্শচ্যুত আর নীতিহীন নির্লজ্জ হলে রাজাকার-আলবদর-আলশামসের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে ক্ষমতায় যেতে চায়। তাই আপনাদের অনুরোধ করছি, যে নেতা যুদ্ধাপরাধীকে নির্বাচিত করতে বলে, সে নেতা কখনোই দেশকে ভালোবাসবে না। তাদের ভোট দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নকে তো আমরা ধ্বংস হতে দিতে পারি না। তাই আসুন সকলে মিলে এবারের নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের বর্জন করি। এছাড়াও আমাদের আরেকটি দায়িত্ব রয়েছে। নিজেরা সচেতন হবার পাশাপাশি অন্যদেরও এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। সেজন্য আমাদের উচিত নিজ এলাকাতে এবং যুদ্ধাপরাধীরা যেখানে প্রার্থী সেখানে যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে বর্জন করার জন্য প্রচারণা চালানো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ বিষয়ে ইতোমধ্যে প্রচারণা শুরু হয়েছে, চলছে লিফলেটিং। আপনারাও বিষয়টি জোর দিয়ে ভাবুন। এছাড়া ইন্টারনেটের মাধ্যমে, ব্লগিঙের মাধ্যমে নিজামী-মুজাহিদ-কামরুজ্জামন-সাকা চৌধুরীর মতো রাজাকারদের ১৯৭১ সালের সেইসব ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড তুলে ধরুন। এবারের নির্বাচনে যদি যুদ্ধাপরাধীদের একজনও জনপ্রতিনিধি হয়, সে লজ্জা আমাদের, নতুন প্রজন্মের।
আমি যেহেতু সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িত, তাই বিভিন্ন স্থান থেকে নির্বাচনের খবরগুলো সংগ্রহ করতে হয়। যেহেতু বিএনপি জামাত জোটের নির্বাচনী কূট পরিকল্পনা এখন অনেকটাই অকেজো; তাই তারা, বিশেষ করে বিভিন্ন স্থানের জামায়াত প্রার্থীরা, তাদের পালিত ক্যাডার ইসলামী ছাত্র শিবিরকে ‘তৈরি রেখেছে’ বলে শোনা যায়। নির্বাচন সম্পর্কে বেগম খালেদা জিয়া যে ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন, তাতে মনে হচ্ছে নির্বাচনের পর তিনি তার কর্তব্যগুলো এখনই ঠিক করে নিচ্ছেন। তাই আমাদের শতভাগ সতর্ক থাকতে হবে, যেনো কোনো সন্ত্রাসী-জঙ্গি-অপশক্তি আমাদের মূল্যবান ভোটকে নষ্ট করতে না পারে। এ বিষয়ে সরকারেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান যখন পরিচালিত হবে, তখন ইসলামী ছাত্র শিবিরের ঘাঁটি অঞ্চলগুলোতেও অভিযান চালানো উচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসংলগ্ন কাঁটাবন মসজিদ এবং তার মেসগুলোর কথা আমরা বারবার উল্লেখ করছি। কারণ এই আবাসিক এলাকাগুলোতে শিবিরের সন্ত্রাসীরা তাদের গোপন সভা ও পরিকল্পনাগুলো করে থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই এলাকাগুলোতে অভিযান চালালেই তাদের অস্ত্রসহ নানা ষড়যন্ত্রের উপাদানগুলো বেরিয়ে আসবে।
যেহেতু মানুষ যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে অনেক সচেতন, তাদের বর্জনের বিষয়ে একমত, তাই তারা বিভিন্ন স্থানে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার জন্য উগ্রবাদী হামলাসহ বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করতে পারে। ইতোমধ্যে এ ধরনের কিছু বিষয়ের আলামতও পাওয়া যাচ্ছে।
একদিকে যেমন রাজাকারের হিংস্রতা, অন্যদিকে স্বৈরাচারের আষ্ফালন। আজকে তাই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কিভাবে আমাদের পথটি তৈরি করে নেবো। এ জন্য অবশ্য ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা রয়েছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করিনি, কিন্তু স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর আজ যেহেতু যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধ করার সুযোগ পেয়েছি, এ যুদ্ধে আমাদের জয়ী হতেই হবে। এ নির্বাচনটি হবে তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মের লড়াই।