এক
সুসময় আর দুঃসময় হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। খটকা লাগলো? মনে হলো, এটা কী করে হয়? হয়, কখনও কখনও হয়। যখন পুড়ে যায় সবকিছু, বিধ্বস্ত হয় সভ্যতার নিটোল ভিত্তি, তখন বৃষ্টির স্রোতেই তা সবুজ হয় আবার, গড়ে ওঠে মানুষের আবাস। তখন কেউ কেউ স্বস্তিবোধ করেন, আবার কেউ কেই আছেন, ভাবেন- এ আবার বানের লক্ষণ নয় তো! অন্ধকারের আরেকটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে আমরা সময় অতিক্রম করেছি। আজ থেকে নয়, নব্বই পরবর্তী সময় থেকেই। স্বৈরাচারি অন্ধকারের পর আমরা যে গণতন্ত্রের বাঁধা সড়কে এসে দঁড়িয়েছিলাম পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, তা আসলে কতোটুকু গণতান্ত্রিক চরিত্রের ছিলো? কিংবা গণতন্ত্রের কতোটুকু আদর্শ গ্রহণ করে গঠিত হয়েছিলো সরকার? এ প্রশ্নের উত্তরগুলো হয়তো খুব ছোটো করেই বলে দেয়া যায়, কিন্তু সহজ করে বলা যায় না। বলা যায় না কারণ, একানব্বই পরবর্তী সময়েই আমরা দেখেছি কীভাবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলো তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার বিএনপি। স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিষ্ঠিত করার কাজ শুরু হয় পঁচাত্তরের পট-পরিবর্তনের পরই। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেই শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। আজ যে আইনের ধারায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, তার ভিত্তি বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের সেই ‘দালাল আইন আদেশ ১৯৭২’। একাত্তরের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সময় যে কুলাঙ্গারেরা পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীকে জেনোসাইড আর নারী নির্যাতনে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছিলো, সেই সব আলবদর, আলশামস, রাজাকারদের বিচারের জন্যই ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘দ্য বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার ১৯৭২’ বা ‘দালাল আইন আদেশ’ শিরোনামে আইন প্রণয়ন করা হয়। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই আইনের আওতায় ২,৮৮৪ টি মামলা দায়ের করা হয়েছিলো। এসব মামলায় সাজা দেয়া হয় ৭৫২ জনকে। এদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী ছিলো। ইতিহাস পাঠ করলে জানা যায়, ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক অধিবেশনে জাতীয় প্রেসক্লাবে বঙ্গবন্ধু এক ভাষণে বলেছিলেন-
বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে আমার আন্দোলন। সেই জাতীয়তাবাদ না থাকলে আমাদের স্বাধীনতার অস্তিত্ব নষ্ট হবে। ধর্মনিরপেক্ষতাও আমাদের আদর্শ। এখানে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নাই। রাজাকার, আলবদরেরা এখন কিছু কিছু বড় বড় প্রগতিশীল নেতার আশ্রয় নিয়ে ‘প্রগতিশীল’ বনে গেছে। আসলে তারা খুনের মামলার আসামি। তাদের নামে হুলিয়া রয়েছে। এখন তাদের কেউ বলে, আমি ওমুক নেতার সেক্রেটারি, কেউ বলে আমি সম্পাদক। এ ক্ষেত্রে আমার কর্তব্য কী, আপনারাই বলুন।
স্পষ্ট বোঝা যায়, বাঙালি জাতির মুক্তির ত্রাতা বঙ্গবন্ধু কতোটা শক্ত অবস্থানে ছিলেন এই নরঘাতকদের বিচারের বিষয়ে। একই সঙ্গে এটাও বোঝা যায়, তাঁর এই দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কাজটি করার প্রয়াসে অনেক শঙ্কা আর বিপদসঙ্কুল পথ সামনে এসেছে। তবে এ উদ্ধৃতাংশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বঙ্গবন্ধু সমাধান চেয়েছেন বাংলার মানুষেরই কাছে। যে বাংলার মানুষ তাঁর নির্দেশে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, যে বাংলার মানুষ তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, যে বাংলার মানুষ নয়টি মাস বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখেই যুদ্ধ করেছেন, স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। সেই বাংলার মানুষের কাছেই বঙ্গবন্ধু উদ্ভুত পরিস্থিতি উল্লেখ করে জানতে চেয়েছিলেন-
এ ক্ষেত্রে আমার কর্তব্য কী, আপনারাই বলুন।
জাতির পিতার এই আদর্শ থেকে সবচেয়ে বড়ো শিক্ষণীয় বিষয়টি হলো, মানুষের উপর আস্থা রেখেই বঙ্গবন্ধু তাঁর কর্মপদ্ধতি ঠিক করেছেন। অর্থাৎ মানুষই সবচেয়ে বড়ো কথা এবং শেষ কথা। সেই মানুষ, যাঁরা বাংলাদেশের সংবিধানে বিশ্বাস করে, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করে, যাঁরা বিশ্বাস করে- একটি শোষণমুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যে কাজ শুরু করেছিলেন, তা তিনি শেষ করতে পারেননি। ট্র্যাজিডি ছাড়া তো মহাকাব্য হয় না, এখানেও হয়নি। যে মানুষটির আজীবন সংগ্রাম ছিলো বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতার মাত্র কয়েক বছর পরই জাতির পিতাকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো। থমকে গেলো বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর জেনারেল জিয়া সামরিক অধ্যাদেশ জারি করে বাতিল করে দালাল আইন। থেমে যায় যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম। ১৯৭৬ সালে ‘Second proclamation order no. 2 of 1976’ জারি করে ধর্ম-ভিত্তিক রাজনীতি করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাদি তুলে দেয়া হয়। ১৯৭৬ এর ১৮ জানুয়ারি নাগরিকত্ব ফিরে পাবার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে আবেদন করতে বলা হয় যুদ্ধাপরাধীদের মাস্টারমাইন্ড কুখ্যাত গোলাম আযমকে। এরপর ১৯৭৮ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে কোনো প্রকার বৈধ ভিসা ছাড়াই বাংলাদেশে অবস্থান করে এই নরপশু। শুরু হয় মোল্লাতন্ত্রের উত্থান। বিপর্যস্ত হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
দুই
যে অপশক্তি বাংলাদেশের মানচিত্রে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতিষ্ঠিত করেছে, সে অপশক্তিরই পুনরুত্থান আমরা দেখেছি নব্বই পরবর্তী নির্বাচনে। অর্থাৎ গণতন্ত্রের মোড়কে পুনরায় মোল্লাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেমন বিশ্ববেহায়া এরশাদের সময় সামরিকতন্ত্রের কালোছায়ায় শ্বাপদের মতো বেড়েছে মোল্লাতন্ত্র। যে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিলো একটি দুনিয়া কাঁপানো মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, যে বাংলার মানুষ অসাম্প্রদায়িকতার দার্ঢ্য চেতনা বুকে নিয়ে লড়াই করেছিলো পাকিস্তানের মতো একটি বর্বর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, ছিনিয়ে এনেছিলো লাল-সবুজের পতাকা; সেই বাংলাদেশে, সেই বাংলার মানুষের বুকের উপর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি। দেশবিরোধী সংগঠন হিংস্র জামায়াতে ইসলামের লকলকে জিভ ক্ষত-বিক্ষত আর অপবিত্র করতে থাকে বাংলার মাটিকে। কিন্তু তখনও তীব্র প্রতিবাদ ওঠে। শহিদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় গণ-আদালত। উজ্জীবিত হয় বাংলার মানুষ, পাকিস্তানি ভূত-সর্বস্ব দর্শনধারীদের কালো শ্যেন দৃষ্টি উপেক্ষা করে রাজপথে নেমে আসে মানুষ। সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে শহিদ জননীর আন্দোলন। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গণআদালতের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের নরঘাতক গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠিত হয়। গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দশটি অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণ-আদালত গোলাম আযমের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে। জাহানারা ইমাম এই রায় বাস্তবায়নের দাবি করেন সরকারের কাছে। কিন্তু তৎকালীন সরকার তো ছিলো পাকিস্তানি পুঁজ থেকে বেড়ে ওঠা অক্টোপাস। তাই রায় বাস্তবায়ন তো দূরে থাক, ২৪ জন বিশিষ্ট নাগরিকসহ জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে অ-জামিনযোগ্য মামলা দায়ের করে সরকার। তারপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতন আর লাঠিচার্জের শিকার হন শহিদ জননীও। অতএব, বাংলাদেশ এমন একটি ক্রান্তিকাল পার করেছে, যখন কর্নেল তাহেরের মতো মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়েছে, শহিদ জননীকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ মাথায় নিয়ে। এই ক্রান্তিকালের উৎসটা যে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট, তা বুঝতে হলে খুব বেশি ইতিহাস জানতে হয় না। তবে জীবন ও রাষ্ট্রীয় বাস্তবতার তো একটা সমীকরণ থাকে; সেই সমীকরণের পথ ধরে হাঁটলে একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়- ক্রান্তিকাল কী কেটে গেছে? নিশ্চয়ই না। কারণ, এখনও এ দেশে সকল যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি হয়নি, এখনও বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়নি জামাত-শিবির, এখনও যুদ্ধাপরাধীদের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে নেয়া হয়নি ব্যবস্থা, এখনও তৃণমূল পর্যায়ে যুদ্ধাপরাধীদের আষ্ফালন দেখতে পাই, এখনও ক্যাম্পাসে ছাত্র হত্যা করে শিবিরের নারকীয় কীটেরা। তাহলে উত্তরণ কোথায়? আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগও ক্ষমতায় এসেছে ১৯৯৬- এর নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, ২০০১ এর নির্বাচনে বিএনপি কিন্তু একা নির্বাচন করেনি, তাদের সাথে গলাগলি করে নির্বাচন করেছে দেশবিরোধী সংগঠন জামায়াতে ইসলাম। অতএব, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বিরোধীরা তাদের পথ ও গন্তব্য খুঁজে নিয়েছে। একাট্টা হয়ে বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ২০০১ সালের পর সারা বাংলাদেশে যে তাণ্ডব বিএনপি-রাজাকার জোট সরকার চালিয়েছে, তা মনে করলে এখনও গা শিউরে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার মিশনে নেমেছিলো তারা। ইতিহাস বিকৃতি, সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের হলাহল- এসব নিয়ে বাংলাদেশ ছিলো তখন এক ভয়াল মেঘমালার নিচে। কিন্তু তারপরও বাংলার মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে, কারণ একাত্তরের যে টান বাংলার ধনুকের ছিলায় ছিলায়- তা শাশ্বত, তা অমলিন, তা চিরন্তন। বর্তমান মহাজোট সরকারের আগের মেয়াদে নির্বাচনী ম্যান্ডেট ছিলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার। সে কাজ তারা ক্ষমতায় এসে শুরু করেছেন। এর জন্য বাংলার মানুষের অকুণ্ঠ সাধুবাদও তারা পেয়েছেন। এবারের মেয়াদেও তারাই রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়েই পথ হাঁটতে হচ্ছে, কেবল সরকারকেই না, জনগণকেও। কারণ, যে যাই মনে করুক, জনগণ ও সরকার আলাদা কিছু নয়, হতে পারে না। কিন্তু একটি বিষয় হয়তো ভাবনার অতলে ডুবে গেছে যে, কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমেই কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন সম্ভব? যারা বলবেন হ্যাঁ, আমার মনে হয় তাদের পুনর্বার ভাবা জরুরী। কারণ বিগত দীর্ঘ সময় ধরে জামায়াতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অপরাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। তারা তাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও জঙ্গী তৎপরতা দিয়ে এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে একটা অর্থনৈতিক ভিতও আছে এবং প্রায়শই জামায়াতের টাকা কথা বলে। আমরা সম্ভবত কখনোই ভুলবো না যে, জামায়াতের রাজনীতির একটা বড়ো দিক হলো বাংলাদেশের বিরোধীতা এবং পাকিস্তানের সেই পচা-গলা দর্শনকেন্দ্রীক। এই অপশক্তিকে কেবল রাজনীতি দিয়ে নয়, দর্শন দিয়েও মোকাবেলা করতে হবে। তার অপ-দর্শনের বিরুদ্ধে তুলে ধরতে হবে আমার মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র আর শুদ্ধতম দর্শন। জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসী কার্যক্রমকে প্রতিহত করা যেমন রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ, তেমনি জামাত-শিবিরের সাম্প্রদায়িকতা আর কূপমণ্ডুকতাভিত্তিক পাকিস্তানি ভূত-দর্শনের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে তীব্র আর সূর্যমুখী সাংস্কৃতিক আন্দোলন। বাংলার আবহমান সংস্কৃতির যে অনন্য ঐতিহ্য, তাকে দিয়েই মোকাবেলা করতে হবে জামাত-শিবিরের মতো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে আমি এর বিকল্প আর কিছু দেখি না।
তিন
যেহেতু জামাত-শিবির কেবল একটি রাজনৈতিক দল নয়, একটি জঙ্গীগোষ্ঠী ও সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী অপশক্তিও। তাই তার বিরুদ্ধে লড়াইটা হওয়া উচিৎ এই তিনটি পর্যায়েই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি যতো শ্লথ হবে, মনে রাখতে হবে, জামায়াত নানা ষড়যন্ত্রের জাল বুনবে। এ অভিজ্ঞতা আমরা দেখেছি যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের সময়। শেষ মুহূর্তেও এই হায়েনারা ষড়যন্ত্র করে গিয়েছিলো। এখনও করছে। ট্রাইব্যুনালের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধ আর আস্থা রেখেই গত বছরের পাঁচই ফেব্রুয়ারি সর্ব সাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে গড়ে উঠেছিলো তারুণ্যের তীব্র গণ-আন্দোলন, যা গণজাগরণ মঞ্চ হিশেবে পরিচিত হয়েছে; এখনও সংগ্রাম করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ নির্মাণের রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েই গণজাগরণ মঞ্চ সুনির্দিষ্ট ছয়দফা দাবি তোলে। এই ছয় দফার মধ্যে একদিকে যেমন জামাত-শিবিরের নিষিদ্ধের বিষয়টি আছে, তেমনি আছে সারা বাংলার মানুষের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ছড়িয়ে দেবার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বয়কট করার ঘোষণাও। গণজাগরণ মঞ্চ তাদের কাজের ধারাটিও সুস্পষ্ট রেখেছে। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি কিংবা জামাত-শিবির নিষিদ্ধের দায়িত্ব ট্রাইব্যুনাল পালন করছে অত্যন্ত সুচারুভাবে। কিন্তু রাষ্ট্র সেখানে একটা পক্ষ। যে যুদ্ধাপরাধীরা বাংলার অগণিত মানুষের স্বজনদের হত্যা করেছে, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করে নিরন্তর আন্দোলন চালিয়ে যাওয়াটাই খুব স্বাভাবিক। মানুষ তো এমনি এমনি পাঁচই ফেব্রুয়ারিতে রাস্তায় নামেননি। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় মানুষকে যে পরিমাণ হতাশ ও ক্ষুব্ধ করেছিলো, তার প্রতিফলনই ছিলো গণজাগরণ মঞ্চ। পক্ষ এখানে একটাই- মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষ। রাজনৈতিকভাবে জামাত-শিবিরকে মোকাবেলা করার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলের। কিন্তু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি দিয়ে জামাত-শিবিরের হায়েনাদের মোকাবেলা করবে সারা বাংলার সাধারণ মানুষ। সেই লক্ষ্যটাতেই এখনও গণজাগরণ মঞ্চ কাজ করছে। মুক্তিযুদ্ধের দর্শনটাকেই বুকে নিয়ে, প্রেরণায় নিয়ে সামনের দিকে যাবার চেষ্টা চলছে। বাধা ছিলো, এখনও আছে। আমরা দেখেছি গণজাগরণ মঞ্চ শুরুর সাথে সাথেই হেফাজতে ইসলাম নামের একটা ভুঁইফোঁড় সংগঠন কীভাবে গণজাগরণ মঞ্চকে নানাদিক থেকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা করেছে। হেফাজতে ইসলামের উত্থানের পেছনে কারা দায়ি? কাদের ভুলের কারণে হেফাজতে ইসলামের মতো একটি মৌলবাদী সংগঠনের কুৎসিত চিৎকারে বিষাক্ত হচ্ছে বাংলার বাতাস? একটু মনে করার চেষ্টা করুন, কীভাবে, কাদের দেয়া অনুমতিতে হেফাজত নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছিলো সারা ঢাকা নগরীতে? এই প্রশ্নের উত্তরগুলো আরেকবার মনে করাটা এখন খুব জরুরী। কারণ, মৌলবাদী অপশক্তিগুলো যে নামেরই হোক, এদের চরিত্র সব সময়ই বাংলাদেশবিরোধী, এরা সব সময়ই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কাজ করবে। গণজাগরণ মঞ্চের অহিংস নীতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এবং সামনের দিকে যাওয়া গণ-আন্দোলনকে পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে আদতে কার লাভ? গণজাগরণ মঞ্চ তো জামাতের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার দাবি জানিয়েছিলো; সবাই জানেন, এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোই বাংলাদেশে জঙ্গী অপতৎপরতার আর্থিক যোগানদাতা। এই জামাতের সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেন রেখে যে হেফাজতে ইসলাম (আদতে জামায়াতে ইসলামই) ঢাকা এসেছিলো তাণ্ডব করতে, সেই হেফাজতের লোকজনকে নিয়েই আমরা দেখেছি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী নেতাদের গত বছরে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন উপজেলায় নির্বাচন করতে। তাহলে দর্শনের শক্তিটা কোথায়? হেফাজতের দর্শন কি, সেটা তো আমার মতো একজন সাধারণ মানুষও বোঝে, যাঁরা সরকারের নেতৃত্বে আছেন, যাঁরা দেশ চালাচ্ছেন, তাঁরা বোঝেন না?
চার
আজ যখন পুলিশ দিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের উপর নির্যাতন হচ্ছে, সহযোদ্ধাদের কেউ কেউ কাতরাচ্ছেন হাসপাতালের বিছানায় কিংবা নিজের ঘরে আর কেউ কেউ জেলখানায় আটক- তখন জানতে ইচ্ছে করে, কী অপরাধ করেছিলো গণজাগরণ মঞ্চ? ছয়দফার কোন দাবিটাকে অযৌক্তিক মনে করে আমাদের অপরাধী ঠাওড়ালো রাষ্ট্র? বিগত নির্বাচনের পর সারাদেশে যখন জামাত-শিবিরের কুলাঙ্গারেরা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস শুরু করলো, তখন গণজাগরণ মঞ্চ তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। যেটুকু সামর্থ্য আছে সেটুকু নিয়েই। আমাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে যখন পাকিস্তান নাক গলাতে আসে, তখন গণজাগরণ মঞ্চ পাকিস্তানি পণ্য বর্জণের ডাক দেয়। দোকানে দোকানে ঘুরে গণজাগরণের কর্মীরা মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করে। ইসলামী ব্যাঙ্কের টাকায় জাতীয় সঙ্গীত গাইবার অপ-উদ্যোগের প্রতিবাদ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আরও অনেক সংগঠনের মতোই। এর কোনটা অপরাধ? আজ এই মুহূর্তে জানতে ইচ্ছে করছে, কীসের আশায় বিগত সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রী শফির মতো একজন বিকৃত মানসিকতার লোকের কাছে গিয়ে বসেছিলেন? আজকে অনুমতির প্রসঙ্গ এনে পুলিশ নির্বিচার নির্যাতন করলো গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের; হেফাজতকে তো অনুমতি দিয়েছিলেন, তাদের ধ্বংসলীলার বিভৎস চিহ্ন তো এখনও মতিঝিল বহন করে চলেছে। সেই হেফাজতের মামলাগুলো নিয়ে কোনো রা নেই সরকারের দিক থেকে। সম্প্রতি একটি দৈনিক পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, গত বছরের ৫ মে রাজধানীতে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবের ঘটনায় দায়ের করা ৪২টি মামলার একটিরও অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারেনি পুলিশ। দশ মাস পার হলেও তদন্তের অগ্রগতি কার্যত শূন্য। এই পুলিশ কোন নৈতিক বলে লাঠিচার্জ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে হেঁটে যাওয়া তরুণদের উপর? হেফাজতের মামলার মূল আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ আন্দোলন শুরুর এক বছরের মধ্যেই গণজাগরণ মঞ্চ দু বার পুলিশের লাঠিচার্জের শিকার হলো। এগুলো কীসের ইঙ্গিত বহন করে? জামাত-শিবির নিষিদ্ধ হচ্ছে না, ইসলামী ব্যাঙ্কসহ জামাতের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও বড়ো বড়ো প্রেস রিলিজ ঝুলিয়ে রাখছে তাদের ওয়েবসাইটে, শিবিরপন্থীরা অনলাইনে প্রতিদিন মুক্তিযুদ্ধ আর জাতির পিতাকে অসম্মান করে যাচ্ছে, অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ৫৭ ধারায় আটক করা হচ্ছে সেই ব্লগারদের, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে ব্লগিং করে, অনলাইনে স্বাধীনতা বিরোধীদের যুক্তিসঙ্গত দাঁতভাঙা জবাব দেয়। রাস্তায় ফেলে পেটানো হচ্ছে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের, জেলখানায় আটক করে রাখা হচ্ছে তাদের- যারা সকল যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছিলো, চেয়েছিলো জামাত-শিবিরের নিষিদ্ধকরণ। খটকা লাগে, অস্বস্তি লাগে- কারণ, আমি তো আওয়ামী লীগকে চিনেছি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠ করে; আমি তো আওয়ামী লীগকে চিনেছি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী আর তাজউদ্দীন আহমেদের ডায়রি পড়ে।
তাই রাষ্ট্রের কাছেই, সরকারের কাছেই প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে- বিভ্রমটা কোথায়? দৃষ্টিতে? চিন্তায়? না নৈতিকতায়? আর যদি মনে করেন কোনো বিভ্রম নেই, তবে যে পরিস্থিতিতেই লেখা হোক না কেনো, সমকালীন বাস্তবতায় আবারও রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতার সে-ই প্রশ্নবোধক লাইনটি রেখে গেলাম- দাঁড়াও, নিজেকে প্রশ্ন করো, কোন পক্ষে যাবে?