শহিদজননী: বাঙালির কোমল গান্ধার

কী অপূর্ব এই স্মরণমুহূর্ত! চারপাশের বেকায়দা সময়ে আমাদের হাবা যৌবন যখন গতপ্রায়, তখনই পৌরাণিক ফেরেশতার মতো ক্যালেন্ডারে নেমে আসে তেসরা মে—শহিদ জননী জাহানারা ইমামের ৯৫তম জন্মবার্ষিকী—আমাদের স্থানাঙ্ক খুঁজে পাওয়ার দিন। কতগুলো নিবিড় বিষন্নতা আমাদের অলৌকিক শুভকামনার সঙ্গে উড়ে যায় তাঁর দিকে—তিনি গ্রহণ করেন, অথবা করেন না; কারণ তিনি তো জানেন—শহিদ রুমীর মতো আসমুদ্রহিমাচল হৃদয় আমাদের…

১৬ আগস্ট ১৯৭৫: কী বলেছিল সেদিনের গণমাধ্যম?

পনেরোই আগস্ট ১৯৭৫। এক ঘোর কৃষ্ণপক্ষ নেমে এসেছিল বাঙলাদেশের বুকে। জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার যে নারকীয় ঘটনা সেদিন ঘটেছিল, তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকেই বাঙলাদেশে সবচেয়ে প্রচলিত কথা হচ্ছে, “কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল।” সন্দেহ নেই, এ কথাটির মাঝেই রয়েছে একটি বড়ো রকমের ফাঁকি। কারণ, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, বেতার…

বাংলাদেশি হত্যা ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বেচ্ছাচার

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আবারও সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হয়েছেন বাংলাদেশি তরুণ। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদভাষ্যে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরি অঙ্গরাজ্যের সেন্ট লুইস শহরের হ্যাম্পটন অ্যাভিনিউর ১১০০ ব্লকের বিপি গ্যাস স্টেশনে এ ঘটনা ঘটে। এর আগে গত ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশি আরেক তরুণ সাঈদ ফয়সালকে কেমব্রিজের চেস্টনাট স্ট্রিটে গুলি করে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের পুলিশ। যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ বা সন্ত্রাসীদের…

স্বাধীনতাসংগ্রাম: উত্তর প্রজন্মের উপলব্ধি

মহান মুক্তিসংগ্রামের প্রায় দুই দশক পর জন্ম নেওয়া প্রজন্মের একজন যখন স্বাধীনতাসংগ্রাম-সম্পর্কিত উপলব্ধির বয়ান লিপিবদ্ধ করতে বসে; তখন কেবল সময়ের কারণেই তার ব্যাসার্ধ যায় বেড়ে, পরিধি হয়ে পড়ে বিস্তৃত। তার ওপর সে প্রজন্ম বেড়ে উঠেছিল এমন একসময়ে, যখন রাষ্ট্রজুড়ে রাজনীতির নামে চলছিল পুতুলের কুচকাওয়াজ। কিন্তু মুক্তিসংগ্রামের অমোঘ ইতিহাস তো আমাদের পরিচয়জ্ঞাপক একমাত্র অঙ্গুরীয়। রাজা দুষ্মন্ত…

উদযাপনের পরাকাষ্ঠা, অনুভূতির দৃশ্যায়ন

বাংলার মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস পাঠে আমরা যতটা নিবিড় হই, ততই আবিষ্কার করি— কী অসামান্যতায় তা বিস্তৃত হয়েছিল পৃথিবীর মানবিক ইতিহাসের মানচিত্রে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর জেনোসাইডের বিরুদ্ধে অপারেশন জ্যাকপট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর সমুদ্রবন্দরে পাকিস্তানি জাহাজ অবরোধ, বাংলার মানুষের জন্য বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের বীরত্ব থেকে ফরাসি নাগরিক জ্যঁ ক্যুয়ের ভালোবাসা কিংবা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে ম্যাডিসন স্কয়ার— বাংলার মুক্তিসংগ্রামের আলোকোজ্জ্বল…

প্রতিদিনের দ্বিজাতিতত্ত্ব

প্রায় তিন বছর আগে আমার প্রিয় মানুষদের একজন শিল্পী-সংগ্রামী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের একটি লেখা পড়েছিলাম তাঁর মোবাইলের ড্রাফট-বক্স থেকে। ‘প্রতিদিনের দ্বিজাতিতত্ত্ব’ কথাটি তাঁর সেই লেখা থেকেই নেয়া। পরবর্তীতে লেখাটি কোনো সংকলনে বেরিয়েছে কিনা জানি না, তবে অনলাইনে দেশভাগ ও দ্বিজাতিতত্ত্ব: একটি আবশ্যিক পুনঃপাঠ শিরোনামে লেখাটি পাওয়া যায়। শুভ দা তাঁর লেখায় ভারতের একজন নাগরিক হিশেবে…

সত্যজিতের মেঘদূতেরা

এই মুহূর্তে সত্যজিৎ রায়ের জনঅরণ্য (১৯৭৫) ছবিটির নায়ক সোমনাথের কথাই মনে পড়ছে। সোমনাথ ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন এবং এটাই সম্ভবত ইতিহাসের অনন্য কৌতুক যে, সত্তর দশকে কোলকাতা শহরের প্রখ্যাত লোডশেডিং তার ডিগ্রিটিকে অবান্তর করে দিয়েছিল। দৃশ্যের এইটুকু ভাষ্য— আমার মতে— সত্যজিৎ রায়ের পক্ষে চূড়ান্ত রাজনৈতিক বক্তব্য। কিংবা মনটাকে সত্যজিতের সৃষ্টির সঙ্গে আরেকটু টেনে যদি ষাটের দশকে…

মদন তাঁতির মুদ্রাদোষ

খ্রিস্টের রক্ত তখনও করবী ফুলের মতো লাল হয়ে জ্বলে ওঠেনি। মৃত্যু তার ঊরু বিস্তার করেছে লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, কোলকাতা অথবা ঢাকায়। কবিতার কয়েকটি পঙক্তিতে লোরকা নিজের ভবিতব্য দেখতে পেলেন স্পেনে— তখন ১৯৪২ সাল; রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রস্থানের পথে পথে পড়ে আছে সাহিত্যের নৈশবিজ্ঞপ্তি, ইতিহাস প্রবেশ করছে বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীর নিদারুণ মন্তাজে। আর কিছুদিন বাদেই ইউরোপের ভূগোল থেকে মুছে…

থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি

আমাদের শাহীন রেজা নূর ভাইয়ের জাহাজটি এবার বন্দর ছেড়ে গেল। যাঁকে ঘিরে একদিন আবর্তিত হয়েছিল আমার মতো সামান্য কলমচির ঘোরলাগা বিকেল সন্ধ্যাগুলো, আজ তাঁর স্মৃতিসমগ্র ছড়িয়ে আছে চারপাশে— ব্যথাতুর বিষণ্ন, অথচ সদা হাস্যময়। কেননা তুড়ি মেরে জীবনকে তাড়িয়ে নেয়ার ডাকনামই তো ছিল শাহীন ভাই। এ কারণেই বুঝি বসন্তবরণের মাহেন্দ্রক্ষণে প্রকৃতি তাঁর জন্য রচনা করেছে এই…

এই বাংলার ইতিহাস আপনারা জানেন না?

লেখার শিরোনামটি শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের দেয়া একটি সংবাদ শিরোনামের অংশ। ১৯৬৪ সালের ১৩ জুলাই দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার প্রথম পাতা জুড়ে প্রকাশিত হয়েছিল ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবসে’ আওয়ামী লীগের জনসমাবেশের একটি ছবি। জনসমুদ্রের সামনে বক্তব্য রাখছেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার ঠিক উপরেই উদ্ধৃতিচিহ্নের ভেতরে দুটো কমা ও দুটো হাইফেন সহযোগে শিরোনাম নির্ধারণ করেছিলেন সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন। জনসভায় দেয়া…

আওয়ামী লীগ, তুমি পথ হারাইয়াছো?

গত ১৩ নভেম্বর ঢাকার বিএমএ মিলনায়তনে খেলাফত যুব মজলিশ ঢাকা মহানগরীর এক অনুষ্ঠানে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নামে স্থাপিত প্রতিকৃতি-ভাস্কর্য নিয়ে যে ধৃষ্টতাপূর্ণ মন্তব্য করেছে— তিনদিন পেরিয়ে গেলেও এ বিষয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ বা প্রতিক্রিয়া চোখে পড়েনি। আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী দলের…

জীবনাধিক জীবন

ছবিটির দিকে তাকাই এবং আবিষ্কার করি দেবব্রত বিশ্বাসকে। শিশির মঞ্চে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে স্নেহাংশু আচার্য, কনক বিশ্বাস ও অন্যান্যদের সঙ্গে তাঁর এই বসে থাকার ভঙ্গিমাই আমাদের কাছে মেলে ধরে দেবব্রত বিশ্বাসের যাবতীয় ইশতেহার। এই ইশতেহার কারিগরের নয়; বরং দ্রষ্টার বিশৃঙ্খলা ও কিমিতি, মৃত্যু ও শূন্যতা, পাপ ও প্রজ্ঞান একই সুরে নিবেদিত হয়েছে অসীমের…

রক্তাক্ত লাল নীল দীপাবলি

প্রতি বছর সাতাশে ফেব্রুয়ারি এলে একবার করে ফিরে যাই ২০০৪ সালে; খবরের কাগজে প্রকাশিত প্রতিভাবান লেখক ও বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময় অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের রক্তাক্ত ক্ষত-বিক্ষত মুখের সে-ই ছবিটির কথা মনে পড়ে। আজ ষোলো বছর পেরিয়ে গেলেও সেই রক্তের ধারা থামেনি; বরং অধ্যাপক আজাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও কতোগুলো নাম— রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ,…

আমাদের শৈশবের পাহারাদার

অনেকের মতো আমিও জানি ফরিদুর রেজা সাগর একজন অসামান্য টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, শিশু সাহিত্যিক এবং দক্ষ সংগঠক। কিন্তু আমি বা আমার মতোন বুকপকেটে শৈশব নিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষের দল যেটা জানে, সেটা অনেকেই জানেন না। ফরিদুর রেজা সাগর একটি ট্রাভেল এজেন্সি চালান। মধ্যবিত্ত স্কুলব্যাগ কাঁধে, মর্নিং শিফটের আধঘুমের ক্লাশে আমরা কতোবার তাঁর সঙ্গে বেড়াতে গেছি। এজন্য…

রক্তবমির দাগ

না। পৃথিবীতে আর কোনো কলেরা হাসপাতাল পাওয়া যাবে না, যেখানে শ্রী ঋত্বিককুমার ঘটকের রক্তবমনের চিকিৎসা হতে পারে। এই উজ্জ্বল চক্ষু মাতাল দণ্ডিত বন্দীর মতো তাঁর সৃষ্টির চাবুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সভ্যতার সদর দরজায়— এবং আমরা, এই কসমোপলিটন পৃথিবীর বাসিন্দারা, এই ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবীর শবযাত্রায় অংশগ্রহণের পূর্বে তাঁর সৃষ্টির দিকে তাকাতে পারি এবং নির্দ্বিধায় সাহসী হতে পারি…