মনীষার আলো: অভিজিৎ ভাবনা

সংশোধনী লেখাটি বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত হয়েছিলো ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে। সেখানে অভিজিৎ রায়ের জন্মসাল ভুলবশত ১৯৭২ লেখা হয়েছিলো। এর দায়-দায়িত্ব লেখক হিশেবে আমারই। পরবর্তীতে আমার সহযোদ্ধারা এই ভুলটি আমাকে ধরিয়ে দেন কিন্তু বিডিনিউজের প্রকাশিত লেখায় সেটি আর সংশোধন করা হয়নি। এখানে সেটি সংশোধন করা হলো। এই মারাত্মক ভুলের জন্য আমি পাঠকের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।…

ক্ষমাহীন নক্ষত্রের আগুন-স্থানাঙ্ক

এখনও মাথা উঁচু করে তাঁর পোর্ট্রেটের সামনে দাঁড়ালে আমাদের মনে পড়ে— এক সাগর রক্ত সংগ্রাম সাঁতরে পেরিয়ে তবুও কী বিষণ্ন স্বাধীনতার সৈকত! এবং এখনও তাঁর চশমার কাঁচেই আমাদের পড়ে নিতে হয় মুক্তিযুদ্ধোত্তর সময়ের বিশ্বাস ও বিদ্রুপ; খুঁজে নিতে হয় বিজয় আর বিস্মৃতির অন্তবর্তী শব্দার্থ ও বাক্যরচনাসমূহ। তাঁর জীবনবৃত্তান্ত এ কারণেই নথিভুক্ত হয় আমাদের প্রজন্মের না-দেখা…

পনেরোই আগস্ট: ষড়যন্ত্রের পথ ধরে জন্ম নেয়া ট্র্যাজিডি

শিরোনামটি শুনে কিছুটা সিদ্ধান্তমূলক মনে হলেও, এই লেখাটি মূলত প্রশ্নমূলক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট। বাঙালির জাতির ইতিহাসে এর চেয়ে কলঙ্কজনক কোনো অধ্যায় নেই। বাঙালি জাতি যে একটি অকৃতজ্ঞ জাতি পনেরোই আগস্ট তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ। এই লেখাটি মূলত সংকলনধর্মী। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট সেই নৃশংসতম রাত্রির প্রেক্ষাপট তৈরির পেছনে…

অনার্য সংগীতগুরুদের প্রতি নিবেদন

আমার জন্ম আজিমপুর ম্যাটার্নিটিতে সুতরাং মৃত্যু যে ভেনিসে হবে না তা বলাই বাহুল্য। এক টুকরো নির্দোষ শৈশবের সুতোয় জীবনের ঘুড়ি আটকে রেখে জীবন পার করার এই বোকামি তাই আমাকে অন্তত মানায়। আমার বা বড়ো করে বললে আমাদের যখন শৈশব তখনও শহরের আকাশ জুড়ে সুউচ্চ দালানের মিছিলগুলো অতো বড়ো ছিলো না। টুকটাক দু একটা চোখে পড়তো;…

অভিজিৎ একটি নক্ষত্রের নাম

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে নির্মমভাবে নিহত হন বিজ্ঞান লেখক, প্রকৌশলী এবং মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম অভিজিৎ রায়। মৌলবাদীদের চাপাতির নির্মম আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান আরেকজন বিজ্ঞান লেখক– অভিজিৎ রায়ের জীবনসঙ্গী বন্যা আহমেদ। এরপর বছর জুড়ে চলে একের পর ব্লগার-লেখক-প্রকাশক ও মুক্তচিন্তকদের হত্যা। বইমেলা প্রাঙ্গণে, জনবহুল টিএসসি এলাকায়…

একুশের মগ্ন নিখিলদৃশ্য

একটি মহৎ দিন হঠাৎ কখনো জাতির জীবনে আসে যুগান্তের সম্ভাবনা নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারী এমনি এক যুগান্তকারী দিন। এই বাক্যদ্বয়কে বলা যেতে পারে বাঙলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস নথিভুক্তির প্রথম বাক্য, বাঙালির আত্মোৎসর্গের প্রসব বেদনার প্রথম চিৎকার। নথিভুক্তিকার হাসান হাফিজুর রহমান। নথিটির নাম একুশে ফেব্রুয়ারী—১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত অমর ভাষা আন্দোলনের প্রথম সংকলন। এরপর…

হতে পারে এটিও একটি বিতার্কিক পাঠ

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিতর্কের মহাবাদলের সামনে কী তপোক্লিষ্টই না দাঁড়িয়ে থেকেছি আমি। বিতর্ক তখন আমার কাছে এক মুনস্ট্রাক অরণ্য—তাকে দেয়া যায় না কিছুই, কেবল নিয়ে আসা যায় ঢের। আমার বলশেভিক চোখে বিতর্কের চক্ষুদান পর্ব সমাপ্ত হবার পর আমি জেনে গেছি শতাব্দীর পর শতাব্দী কিছু সব্বনেশে খশড়া জমা হয়েছে মানব জাতির ভল্টে। অতএব বিতর্ক থেকে বেরোনোর প্রশ্নই…

‘বইয়ের’ বই কই?

ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক— বইয়ের সঙ্গে কিন্তু আমাদের জীবনের অনেকখানি সময় কাটে। কেউ বই পড়তে ভালোবাসেন, কেউ বই বেঁচতে ভালোবাসেন। আজকাল অবশ্য একটি সৌখিন শ্রেণি তৈরি হয়েছে, যারা বই সাজিয়ে রাখতে ভালোবাসেন। বিষয়টি চমকপ্রদ। বই আমাদের চিন্তার সৌন্দর্য বর্ধনের সঙ্গে সঙ্গে ঘরেরও সৌন্দর্য বর্ধন করছে। উপযোগিতা বাড়ছে। এটাও তো একটি প্রাপ্তি। স্কুলে পড়ার সময়…

আমাদের প্রত্যাখ্যানের মাতৃভাষা

কী এক অলৌকিক সমাপতন! ১৯৬৭- এর যে হেমন্তের দিনে আজাদ আবুল কালাম জন্ম নিচ্ছেন স্বাধীনতা সংগ্রামমুখর বাঙলাদেশে, প্রায় তখনই গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস তাঁর যাদু-বাস্তবতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন মাসন্দো শহরের বুয়েন্দিয়া পরিবারের সাত প্রজন্মের মধ্যে। আজাদ আবুল কালাম তাহলে নিঃসঙ্গতার একশ বছরের  সমবয়ষ্ক! আর তাই হয়তো হোসে আর্কেদিয়া ও উরসুলা বুয়েন্দিয়ার নতুন গন্তব্যে যাত্রা বৃত্তান্তের মতোই আজাদ…

এলিজি নয়, তাঁর সূর্যমুখী দর্শন ও আমাদের রাজনীতির বাস্তবতা

কী এক অলৌকিক সমাপতন! ১৯২০এর যে চৈত্রের দিনে গোপালগঞ্জের মধুমতি নদীর তীরবর্তী টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্ম নিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু, প্রায় তখনই মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে সত্যাগ্রহ আন্দোলন ভারতের শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিসেবে সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। বঙ্গবন্ধু তাহলে সত্যাগ্রহ দর্শনের সমবয়স্ক! আর তাই হয়তো বাংলার মানুষের জাতীয়তাবাদ উন্মেষের প্রতিটি আন্দোলনের বাঁক নির্মাণ করে একটি…

জহির রায়হান— আমার শক্তি, আমাদের ত্রাতা

আমরা আরেকবার জহির রায়হানের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারি; যাবতীয় ক্ষোভ, দ্রোহ, স্বপ্ন আর অভিমানের কার্নিভ্যাল নিয়ে আমরা জহির রায়হানের কাছে নিবেদন করতে পারি আমাদের সময়ের প্রয়োজন। ইতিহাসের ক্লাশরুমে আমরা জেনেছি, ব্ল্যাকবোর্ডে নয়; বরং চোখ রাখতে হয় ইতিহাস নির্মাণ-শ্রমিকদের চোখে, জেনে নিতে হয় রক্ত আর রক্তজবার পার্থক্য। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের ভেতরে তেইশ বছরের শোষণ-বঞ্চনার যে…

আড্ডার বই চাই

গতকাল ছিলো বুদ্ধদেব বসুর জন্মবার্ষিকী। এই প্রসঙ্গেই আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মোনে হলো— বাঙালির কোনো আড্ডা নেই। ছোটোবেলা আমাদের কাছে আড্ডা মানে ছিলো যাচ্ছেতাই ব্যাপার। একেবারে উচ্ছন্নে না গেলে কেউ আড্ডাবাজিতে নাম লেখায় না। খানিক বড়ো হয়ে বুদ্ধদেব বসুর আমার যৌবন পড়ে দেখলাম, নাহ— ব্যাপারটা মোটেই খারাপ না যেহেতু ইংরেজি বিভাগের ডাকসাঁইটে ছাত্রও নিয়মিত…

বাঙলাদেশ এখনও ইয়াসমিনদের মৃতদেহ

আর্তনাদের কি কোনো পরিভাষা হয়? কিংবা হাজারটা পরিভাষা করে দিলেও আমাদের প্রথাগত সাধের সমাজের কানে কি সে-ই আর্তনাদ পৌঁছায়? মৃতদেহ কি কখনও দেখায় নিজের পরিচয়পত্র? কিংবা দেখালেও এই ভদ্রলোকের সমাজ, এই শান্তির সমাজ তা মনে রাখবে? প্রশ্নগুলো দার্শনিকের জিজ্ঞাসার মতো লাগছে কি? হতে পারে; কারণ দর্শন মানে তো ‘দেখা’ও— দেখতে দেখতে এইসব প্রশ্ন মাথার ভেতরে…

টকের জ্বালায় দেশ ছাড়লাম, তেঁতুল তলায় বাস

লেখার শিরোনামটি আসলে আমাদের বর্তমান অবস্থারই একটি প্রবচনিক রূপ, সাম্প্রতিক বাঙলাদেশের চালচিত্র। ‘কোথায় দাঁড়িয়ে বাঙলাদেশ?’— এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের। মনে হচ্ছে, আমরা প্রত্যেকেই যেনো বাস করছি একটি দুঃস্বপ্নের মধ্যে, ভয়াল মেঘমালার নিচে আমাদের ত্রস্ত চলন। ২০১৫ সালের অর্ধেকও শেষ হয়নি, অথচ তিনজন ব্লগার ও লেখককে হত্যা করা হলো নৃশংসভাবে। ২৬…

হৃদয় ও রাজনীতির কোলাজ

মাত্র আটটি চলচ্চিত্র- এরপর তিনি মহাপ্রস্থানের পথে এগিয়েছেন। মাত্র আটবার কড়া নাড়ায় মহাকাল তাঁকে দরজা খুলে দেয়; এরপর তিনি প্রবেশ করেন অনন্ত শূন্যলোকে- অর্থহীন সময়কে করে তোলেন অর্থপূর্ণ শুভ্র অথবা কালোত্তীর্ণ জীবনের এপিটাফ। এরকম আশ্চর্য ব্যতিক্রম অবশ্য ঋত্বিক ঘটক ছাড়াও এসেছিলো আন্দ্রেই তারকোভস্কির সময়ে- তাঁর সমাপ্ত চলচ্চিত্রের সংখ্যা সাত। আজ মাঝে মাঝে মনে হয় এঁরা…