শহিদজননী: বাঙালির কোমল গান্ধার

কী অপূর্ব এই স্মরণমুহূর্ত! চারপাশের বেকায়দা সময়ে আমাদের হাবা যৌবন যখন গতপ্রায়, তখনই পৌরাণিক ফেরেশতার মতো ক্যালেন্ডারে নেমে আসে তেসরা মে—শহিদ জননী জাহানারা ইমামের ৯৫তম জন্মবার্ষিকী—আমাদের স্থানাঙ্ক খুঁজে পাওয়ার দিন। কতগুলো নিবিড় বিষন্নতা আমাদের অলৌকিক শুভকামনার সঙ্গে উড়ে যায় তাঁর দিকে—তিনি গ্রহণ করেন, অথবা করেন না; কারণ তিনি তো জানেন—শহিদ রুমীর মতো আসমুদ্রহিমাচল হৃদয় আমাদের…

১৬ আগস্ট ১৯৭৫: কী বলেছিল সেদিনের গণমাধ্যম?

পনেরোই আগস্ট ১৯৭৫। এক ঘোর কৃষ্ণপক্ষ নেমে এসেছিল বাঙলাদেশের বুকে। জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার যে নারকীয় ঘটনা সেদিন ঘটেছিল, তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। কিন্তু পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকেই বাঙলাদেশে সবচেয়ে প্রচলিত কথা হচ্ছে, “কতিপয় বিপথগামী সেনাসদস্য বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল।” সন্দেহ নেই, এ কথাটির মাঝেই রয়েছে একটি বড়ো রকমের ফাঁকি। কারণ, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, বেতার…

স্বাধীনতাসংগ্রাম: উত্তর প্রজন্মের উপলব্ধি

মহান মুক্তিসংগ্রামের প্রায় দুই দশক পর জন্ম নেওয়া প্রজন্মের একজন যখন স্বাধীনতাসংগ্রাম-সম্পর্কিত উপলব্ধির বয়ান লিপিবদ্ধ করতে বসে; তখন কেবল সময়ের কারণেই তার ব্যাসার্ধ যায় বেড়ে, পরিধি হয়ে পড়ে বিস্তৃত। তার ওপর সে প্রজন্ম বেড়ে উঠেছিল এমন একসময়ে, যখন রাষ্ট্রজুড়ে রাজনীতির নামে চলছিল পুতুলের কুচকাওয়াজ। কিন্তু মুক্তিসংগ্রামের অমোঘ ইতিহাস তো আমাদের পরিচয়জ্ঞাপক একমাত্র অঙ্গুরীয়। রাজা দুষ্মন্ত…

উদযাপনের পরাকাষ্ঠা, অনুভূতির দৃশ্যায়ন

বাংলার মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস পাঠে আমরা যতটা নিবিড় হই, ততই আবিষ্কার করি— কী অসামান্যতায় তা বিস্তৃত হয়েছিল পৃথিবীর মানবিক ইতিহাসের মানচিত্রে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর জেনোসাইডের বিরুদ্ধে অপারেশন জ্যাকপট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর সমুদ্রবন্দরে পাকিস্তানি জাহাজ অবরোধ, বাংলার মানুষের জন্য বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের বীরত্ব থেকে ফরাসি নাগরিক জ্যঁ ক্যুয়ের ভালোবাসা কিংবা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে ম্যাডিসন স্কয়ার— বাংলার মুক্তিসংগ্রামের আলোকোজ্জ্বল…

প্রতিদিনের দ্বিজাতিতত্ত্ব

প্রায় তিন বছর আগে আমার প্রিয় মানুষদের একজন শিল্পী-সংগ্রামী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের একটি লেখা পড়েছিলাম তাঁর মোবাইলের ড্রাফট-বক্স থেকে। ‘প্রতিদিনের দ্বিজাতিতত্ত্ব’ কথাটি তাঁর সেই লেখা থেকেই নেয়া। পরবর্তীতে লেখাটি কোনো সংকলনে বেরিয়েছে কিনা জানি না, তবে অনলাইনে দেশভাগ ও দ্বিজাতিতত্ত্ব: একটি আবশ্যিক পুনঃপাঠ শিরোনামে লেখাটি পাওয়া যায়। শুভ দা তাঁর লেখায় ভারতের একজন নাগরিক হিশেবে…

ফেইসবুক অ্যালগরিদম ও কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

গত দুই দশকেরও কম সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে যে সংখ্যক ব্যবহারকারী সক্রিয় হয়েছেন, ডিজিটাল দুনিয়ায় তা এক বিস্ময়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সব শ্রেণির মানুষকে কথা বলার বা মত প্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছে— এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একই সঙ্গে তাদের নিজস্ব বিধি-বিধান আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক অ্যালগরিদম কোথাও না কোথাও মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি…

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর: প্রকৃত মধ্যবিত্তের সন্ধানে

বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেরও প্রায় ছিয়াশি বছর আগে ব্রিটিশ আমলাদের উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েটদের নিয়ে গঠিত এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় জনগণকে অপ্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিল। নব-প্রতিষ্ঠিত সেই সংগঠনের তরুণ নেতৃত্বের উদ্দেশে ব্রিটিশ আমলা অ্যালেন অক্টেভিয়ান হিউম একটি চিঠিতে লিখেছিলেন— “এদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা বুঝতে পারছে না…

প্রজন্মের মননে গেরিলা তৎপরতার কলাকৌশল

বই না বলে গেরিলা অপারেশনের ম্যানুয়াল বলাই বরং ভালো— অন্তত আমার বিবেচনায়। তবে এই প্রচেষ্টা সম্মুখসমরে নয়, প্রজন্মের বিভ্রান্তিকর মগজে আর প্রায় ক্ষয়ে-যাওয়া মননের অলিতে-গলিতে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস খুঁজতে গেলে আমরা বুঝি, গত পঞ্চাশ বছরে আমাদের পায়ের তলার মাটি কেমন আলগা হয়ে গেছে। নরম পলিমাটির বদলে সেখানে ফাঁদ পেতেছে বিভ্রান্তির চোরাবালি। আশাবাদী অগ্রজেরা…

বিপন্নতাকে কৃষ্ণচূড়ায় পাল্টে ফেলার দশক

বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে গত শতাব্দীর ষাটের দশক এক অবিস্মরণীয় গণজাগরণের দশক। মূলত এই দশকের আলোতেই রচিত হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর অলোকসামান্য ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। পৃথিবীব্যাপী মুক্তিকামী মানুষের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সর্বকালের এক অখণ্ড অনুপ্রেরণা। বাংলার মানুষের মুক্তিসংগ্রামের যে বীজ সাংস্কৃতিক ভূমিতে রোপিত হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্বে, তার রাজনৈতিক বিকাশ প্রাপ্তির সময় হিসেবে চিহ্নিত…

আজ চৌদ্দই ডিসেম্বর: একাত্তরের এইদিনে আকাশ থমকে ছিলো

আজ চৌদ্দই ডিসেম্বর। বিপন্নতার অমোঘ সুরে বাঁধা এক মহার্ঘ অর্কেস্ট্রা। ১৯৭১ সালের মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটি দিনই ছিলো মানবিক-অমানবিক বিভিন্ন অনুভূতির এক মৌলিক আখ্যান। পঁচিশে মার্চ থেকে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর অমানবিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে তীব্র সূর্যমুখী প্রতিবাদ শুরু করেন বাঙলার মুক্তিকামী মানুষেরা, তারই সার্থক এপিক শিরোনাম— মুক্তিযুদ্ধ। বাঙলার মানুষের ঐতিহ্যগত চেতনার সাতসুর যেমন গভীরে প্রোথিত এক…

সেই অবিনাশী উচ্চারণ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যদি একটি মহাকাব্য হয়, তবে তার প্রবেশদ্বার হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের সেই অবিনাশী উচ্চারণ। একটি মুখবন্ধ—যার মধ্যে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি স্তর-উপস্তর ব্যাখ্যা করা আছে; আছে নির্যাতিত হওয়ার খতিয়ান, নির্দেশনামা, করণীয় এবং অকরণীয়সমূহ। মাত্র ঊনিশ মিনিটের এই পারাবারপ্রতিম ভাষণে জাতির জনক আসলে রচনা করেছিলেন আমাদের স্বাধীনতার সংজ্ঞা, তাকে বিস্তৃত করেছিলেন ‘মুক্তি’র অভিধায়; এবং…

বিপন্নতাকে কৃষ্ণচূড়ায় পাল্টে ফেলার লড়াই

মানবসভ্যতার ইতিহাসে পড়েছি— লৌহ যুগ, তাম্র যুগ, প্রস্তর যুগ, নব্যপ্রস্তর যুগ— গোটা পৃথিবীতে এখন চলছে বিপন্নতার যুগ। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ…সব, সবটাই যেন বিপন্নতার কালো স্কার্ফে মুড়িয়ে দিয়েছে কোনো এক অন্ধ জাদুকর। সে নিজে অন্ধকার দেখতে পায় না বলে স্বীকার করে না আলোর অস্তিত্ব। ফলে বিপন্নতার রাত্রি ক্রমাগত গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। বিপন্নতার এই…

পনেরোই আগস্ট: ষড়যন্ত্রের পথ ধরে জন্ম নেয়া ট্র্যাজিডি

শিরোনামটি শুনে কিছুটা সিদ্ধান্তমূলক মনে হলেও, এই লেখাটি মূলত প্রশ্নমূলক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয় ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট। বাঙালির জাতির ইতিহাসে এর চেয়ে কলঙ্কজনক কোনো অধ্যায় নেই। বাঙালি জাতি যে একটি অকৃতজ্ঞ জাতি পনেরোই আগস্ট তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ। এই লেখাটি মূলত সংকলনধর্মী। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট সেই নৃশংসতম রাত্রির প্রেক্ষাপট তৈরির পেছনে…

তিনি আমাদেরই বঙ্গবন্ধু

কিছুদিন আগে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন স্যারের সম্পাদিত ও সংকলিত একটি বই পড়ছিলাম। ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ শিরোনামের দুই খণ্ডের এই বইটির বিষয়বস্তু যেমন গুরুত্বপূর্ণ ও নতুন গবেষণার জন্যে অনুপ্রেরণামূলক, তেমনি নানাবিধ চিন্তা ও বিশ্লেষণে ঋদ্ধ তার ভূমিকা অংশটুকু। ভূমিকার শুরুর দিকে বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তৃতার কথা উল্লেখ করে মামুন স্যার লিখেছেন— ‘…একবার…

হতে পারে এটিও একটি বিতার্কিক পাঠ

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিতর্কের মহাবাদলের সামনে কী তপোক্লিষ্টই না দাঁড়িয়ে থেকেছি আমি। বিতর্ক তখন আমার কাছে এক মুনস্ট্রাক অরণ্য—তাকে দেয়া যায় না কিছুই, কেবল নিয়ে আসা যায় ঢের। আমার বলশেভিক চোখে বিতর্কের চক্ষুদান পর্ব সমাপ্ত হবার পর আমি জেনে গেছি শতাব্দীর পর শতাব্দী কিছু সব্বনেশে খশড়া জমা হয়েছে মানব জাতির ভল্টে। অতএব বিতর্ক থেকে বেরোনোর প্রশ্নই…