বাঙলা নববর্ষ: ব্রাত্যজনের ভাবনা

নববর্ষ এলেই আমার মধ্যে এক প্রগাঢ় ভাবনার উদয় হয়। আমি ভাবতে শুরু করি- বাঙালির নববর্ষ আসলে বাঙালির চৌকাঠে কতোটা আপন হয়ে আসে। মানে, কতোটা তা উৎসবের, কতোটা তা উদযাপনের, আর কতোটাই বা তার চর্চার। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে আমি যেটুকু বুঝি, তাতে সংস্কৃতি আমার কাছে একটি বড়ো ধারণা। একই সঙ্গে তার মধ্যে যে গভীর বাঙময়ী প্রত্যয়…

‘কেনো’ এবং ‘কেনো নয়’

আমরা সম্ভবত বিনির্মানবাদের জগতে বসবাস করি। অভিমতটি ব্যক্তিগত বলেই এ সম্বন্ধে আমার যুক্তি হলো— সভ্যতার এমন একটি বিন্দুতে আমরা অবস্থান করছি, যেখানে দাঁড়িয়ে আমাদের চিন্তার সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী কোনো ভবিষ্যত আমাদের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। এর মানে এই নয় যে— একেবারেই ভিন্ন একটি ভবিষ্যত আমরা দেখতে পাই না বা দেখা হবে না তবে আপাত দৃষ্টিতে আমরা পূর্ববর্তী…

অতএব, রক্ষকই অবশেষে ভক্ষক

ঠিক আভিধানিক অর্থকে মাথায় রেখে এখানে ‘রক্ষক’ কিংবা ‘ভক্ষক’ শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয়নি। ব্যবহার করা হয়েছে আস্থার মাপকাঠি বিবেচনা করে। বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিশেবে আমি কতোটা আস্থা রাখতে পারি আমার রাষ্ট্র কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর উপর? এ প্রশ্নটি খুঁজতে গিয়েই লেখাটির সূত্রপাত। চারপাশে ঘটে যাওয়া অনেকগুলো বিষয়ই হতে পারতো এ লেখার প্রভাবক, কিন্তু গত…

এই লেখাটি আপনাদের ভালো লাগবে না

কারও ভালো লাগার দায় থেকে লেখাটি লিখছি না। ভালো যে লাগবে না, তা তো শিরোনামেই আমি উল্লেখ করেছি। বাঙলা নববর্ষ নিয়ে ভাবতে গেলে আমার মনে হয়, আমাদের নববর্ষ উদযাপনের ধারটি বদলে যেতে পারতো। বাঙালির ইতিহাস কেবল উদযাপনের নয়, বাঙালির ইতিহাস এক গভীর দার্শনিক চিন্তার ইতিহাস। বাঙালির সবটুকু মহিমান্বিত ধারায় এক অভূতপূর্ব চিন্তারেখা খেলা করে। সেই…

পঁচিশে মার্চ ১৯৭১

দৃষ্টিজুড়ে আলো থাকলেই অন্ধকার ঘুচায় না। আঁধারেরও একটা রঙ আছে, তারও একটা সত্তা আছে। ওইটুকু বাদ দিলে যে নিকষ ভয়ঙ্কর রাত্রির পর্দা নামে, তাতে ভয় ধরে; ভয়ার্ত মনের মধ্যে বাসা বাধে শব্দেরা; শব্দগুলোর কান্না পায়, চিৎকার করে কাঁদে, কেবল কাঁদে আর কাঁদে; ইতিহাসের পনেরো খণ্ডে শব্দগুলো আমার বুলেট হয়ে যায়। আমি তোমাদের বিস্তীর্ণ ব্যস্ত জীবনে…

জেনোসাইডের নীরব সাক্ষী

আমার কী নাম? নামফলক দেখে হয়তো বলে দিতে পারবে অনেকেই। কেউ কেউ কপাল কুঁচকে বলবেন- পাথরের আবার নাম! জড় পদার্থের নামের কী দরকার? কিন্তু আমি কি কেবলই জড় পদার্থ? কেবলই কি এক অসাড় চলৎশক্তিহীন পাথর আমি? কেউ কী কখনো আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় একবার ফিরে তাকিয়েছো? একবার ভেবে দেখেছো- আমি আসলে কথা কইতে জানি,…

আমি আমার আত্মার আত্মীয়দের কথা বলছি

এই লেখাটির ক্ষেত্রে আমার প্রথম প্রেরণা ও অনুসন্ধান ছিল গবেষক সাজিদ হোসেনের গবেষণাগ্রন্থ একাত্তরের যুদ্ধশিশু: কতটা ভালোবাসায় কতটা অবহেলায় বইটি। যুদ্ধশিশুদের ছবিগুলোও তাঁর গ্রন্থ থেকেই নেয়া।   ঘড়ির কাঁটাও মাঝে মাঝে পেছনে ঘুরে; সভ্যতার দীপ্র দুপুরে নামে মধ্যযুগীয় অন্ধকার। সে-ই অন্ধকারে রাজপথে নামে দানব, হুঙ্কারে আতঙ্কিত হয় চারদিক, নেমে আসে মৃত্যু-তুহিন এক প্রকট প্রলয়। ১৯৪৭…

শহিদ রুমী: আমার ফ্ল্যাশব্যাকে, আমার প্রত্যাশায়

একটি বিশেষ স্টাইলে নিজের তোলা একটি ছবি বাঁধিয়ে রাখার খুব ইচ্ছে আমার। কোমরে হাত, ঘাড়টা আমার ডান হাতের দিকে বাঁকানো। অবশ্য ছবিটা যিনি দেখবেন, তার মনে হবে আমি বাঁ দিকে ঘাড় কাত করে রেখেছি। ছবিটার উপরে অ্যামবুশ করে লিখে রাখা হবে জীবনানন্দ দাশের সে-ই অনন্য কবিতার পঙক্তি, আবার আসিবো ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়.. ..…

মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদ: নিঃসঙ্গ সময়ের সারথি

এমন একটি লেখা লেখার ইচ্ছে আমার ছিলো না। নিঃসঙ্গ বাতায়নের সাথে গুবাক তরুর সারির কথোপকথন আর কখনো হবে না। এ-ও এক ট্র্যাজিডি- গ্রীক ট্র্যাজিডির সাথে সামঞ্জস্য; কেবল ভাগ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়- কিংবা এরও বাইরের কিছু। আমি জানি না, ক্যামেরার কোন অ্যাঙ্গেলে কথা বলতে ভালোবাসতেন আশফাক মুনীর মিশুক। জানি না সেলুলয়েডের সাথে কেমন প্রেম ছিলো তারেক…

নীলিমা ইব্রাহিম: বাঙালির নিভৃত নিরঞ্জনা

এক আকাশের দিকে তাকালে ‘সাঙান গগনে ঘোর ঘনঘটা’র কথাই মনে হয়। এ যে আষাঢ় মাস, বর্ষা ঋতু- সে আর পঞ্জিকার পাতা খুলে বলতে হয় না। প্রকৃতিই সময়ের দর্পন হয়ে দেখা দেয়। বর্ষা বাঙালির প্রাণের ঋতু- অনেকভাবেই ভেবেছি কথাটা; সত্যিই এ ঋতু আমাদের ফসলের ঋতু, রবীন্দ্রনাথের ঋতু, পদাবলীর ঋতু আর অবশ্যই কালিদাসের ঋতু। নানা বাঁকে বর্ষা…

হঠাৎ এক আশ্চর্য বিকেল

লেখার কতোটুকু ফরমায়েশি আর কতোটুকু আয়েশি? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া ভার। তবে এর মাঝেও একটি সান্ত্বনা এই যে- মানুষ কিছু প্রশ্নের কোনো উত্তর প্রত্যাশা করে না। যেমন, ছোটোগল্প আসলে কতো ছোটো? কিংবা মনেরও কি মন আছে? তাই লেখা যেমনই হোক- তার উৎসমূলের হিসেব খুঁজতে যাওয়াটা বোধ হয় উচিত হবে না- কারণ এটি রবীন্দ্রনাথের লেখা…

তাজউদ্দীন আহমদ: জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি

ভূমিকার আগের অধ্যায় ২৩ জুলাই। ১৯২৫ সাল। কেমন ছিলো সেদিনের রূপ? সেদিন কি বৃষ্টি ছিলো, কিংবা গরম, রোদের বাড়াবাড়ি সেদিনের মানুষের কাছ কি একটু বেশি মনে হয়েছিলো? অথবা সেদিনের সেই দিনটিতে শাপলার জলে খেলা করেছিলো শালুক, ম্রিয়মান সন্ধ্যায় দহলিজে বসে কেউ কি আপন মনে নিবিড় প্রার্থনায় মগ্ন ছিলো? সেদিনের দৃশ্যে সবুজের সাথে গাঢ় লালের একটি…

সেই আটটি স্মারক ডাকটিকেট

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- এ যেনো এক মহীরূহ। নানা বর্ধিষ্ণু সীমা-পরিসীমা তার। ইতিহাসের অলি-গলি ঘুরে যখনই কেউ এসে পড়বেন এই অনন্য অধ্যায়ে- বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে তখনই তার অবস্থা দাঁড়াবে ‘প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি’র মতো, ফলে ‘অকারণ পুলকে’ তিনি খুঁজে ফিরবেন ‘স্বজাতির গুলিবিদ্ধ করোটি’। উনিশশো একাত্তর এমনই এক ইতিহাস, ‘পুরাতনী তুমি নিত্য নবীনা’ বাঙালির আত্মজ অহঙ্কারের সাথে…

আমার ভাষার চলচ্চিত্র

বনে আছে দ্বন্দ্বের বিন্যাস, নাগরিকতার সঙ্গে লৌকিক জীবনের। কোনো মানুষই ঠিক সে-অর্থে অখণ্ড নয়, প্রত্যেকের মধ্যেই আছে অপূর্ণতা। এ অপূর্ণতাকে প্রেক্ষণবিন্দুতে রেখেই শিল্পসৃষ্টি আর সেই সৃষ্টিকে ধারণ করা। বৃহৎ অর্থে শিল্পের এ বিশাল আকাশ জুড়ে থাকা রঙধনুর সবচেয়ে উজ্জ্বল রঙটি হয়তো চিহ্নিত করা যাবে না, কিন্তু ভাবনার পরিসীমাটা যদি বাঙালি সমাজ আর বাঙালি মধ্যবিত্তের মানসপট…

সেই মায়েদের মা দিবস

মা দিবস শেষ হলো। দিবস উদযাপন অত্যন্ত আনন্দঘন একটি বিষয়। বিভিন্ন দিবসের বিভিন্ন প্রতিপাদ্য- বাঙালি নানাভাবে সেসব দিবস উদযাপন করে থাকেন, গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার পরীক্ষার্থীরা এসব দিবসের প্রতিপাদ্য মুখস্থ করে রাখেন, দিবসকে কেন্দ্র করে হাল আমলের টি-শার্ট, পোস্টার, শুভেচ্ছা কার্ড আরও কতো কী! গণমাধ্যমগুলোতে বিশেষ দিবসের বিশেষ সংবাদ, বিশেষ অনুষ্ঠান। মানে সবকিছু মিলিয়ে উৎসবমুখর জাতির উৎসবের…